একজন সফল উদ্যোক্তা হবার স্বপ্ন একটু উত্তেজনাপূর্ণ এবং উদার প্রচেষ্টা। আর এর পেছনে রয়েছে অনেক গল্প, জমে থাকে অনেক কথা। আবার অনেকে উদ্যোক্তা হবার স্বপ্ন দেখে দেখে বড় হয়। নিয়ে নেয় কিছু পদক্ষেপ। কিন্তু এই পদক্ষেপে থাকে না কোনো পূর্ব অভিজ্ঞতা। তাই অনেকেই করে বসে ভুল, নিয়ে নেয় ভুল পদক্ষেপ। কিন্তু যদি কাজের প্রতি ভালোবাসা থাকে তাহলে যেকোনো ভুল থেকেই আবার উঠে দাঁড়ানো যায়, হওয়া যায় একজন সফল উদ্যোক্তা।
একজন সফল উদ্যোক্তা হবার সংজ্ঞা একেকজনের কাছে একেকরকম। কারো কাছে সাফল্য মানে অর্থ উপার্জন করা আবার অনেকের কাছে সাফল্য মানে প্রিয়জনের সাথে নিশ্চিন্তায় কিছু গুরুত্বপূর্ণ সময় কাটানো। অনেকের কাছে সাফল্য মানে পরিবারের সকলকে সুখী রাখা আবার অনেকের কাছে সাফল্য মানে নিজেকে সুখী রাখা।
কিন্তু এই সফলতার পেছনের গল্প গুলো আমাদের কাছে অজানা। আমরা প্রায়ই হায় হুতাশ করি প্রতিটি ধাক্কা খাবার পর। প্রতিটি ভুলের পর নিজেদের দোষারোপ করি। অনেকেই হাল ছেড়ে দেই। অথচ আমরা এটাই বুঝি না যে হাল ছেড়ে দেওয়া সফলতা নয় বরং হাল ধরে রাখাই সফলতা। যারা যারা “আলিবাবা.কম” এর কথা শুনেছেন তারা নিশ্চয়ই ইতিমধ্যে শুনেছেন ‘জ্যাক মা’ এর কথা। জ্যাক মা চায়নার এক গরীব পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছেন এবং সেখানেই বড় হয়েছেন। তার কলেজ ভর্তি পরীক্ষায় তিনি দু’বার ফেইল করেছেন এবং ডজনখানিক চাকরী থেকে তাকে বহিষ্কৃত করা হয়েছে। জ্যাক মা এর সময়কালীন চায়নার অবস্থা তেমন ভালো ছিলো না। তাই তার যুবক বয়সে সে এবং তার পরিবার তেমন টাকাও পেতেন না।
১৯৭২ সালে যখন ইউএস এর প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন জ্যাক মা এর শহর ঘুরে আসলো তার পরপরই জ্যাক মা এর শহর পর্যটন কেন্দ্রে পরণত হলো। জ্যাক মা সকালে ঘুম থেকে উঠে শহরের প্রধান হোটেলে যেত এবং পর্যটকদের শহর ঘুরে দেখানোর প্রতিশ্রুতি দিত। কিন্তু শর্ত হচ্ছে পর্যটকদের তাকে ইংলিশ শেখাতে হবে। তার নাম “জ্যাক” এমনি একজন পর্যটকের দেওয়া। কলেজের এবং গ্রাজুয়েশন এর গন্ডি বহুকষ্টে পেরিয়ে যখন তাকে চাকরীর জন্য বেগ পেতে হচ্ছিলো তখন সে একটি লোকাল ভার্সিটিতে ইংলিশ শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পেয়ে যায় এবং তার বেতন ছিল মাত্র ১২ ডলার।
জ্যাক মা এর কম্পিউটার সম্পর্কে কোনো জ্ঞান ছিল না,ছিল না জ্ঞান কোডিং আর ইন্টারনেট সম্পর্কে। কিন্তু ১৯৯৫ সালে ইউএস এর একটি ট্রিপে যাবার সময় সে ইন্টারনেটের সাথে পরিচয় হয়। মজার ব্যাপার হচ্ছে জ্যাক মা ইন্টারনেটে প্রথমবার সার্চ দিয়েছিল “বিয়ার”। সে অবাক হয়ে চাইনিজ কোনো বিয়ার না দেখে। সেই থেকে সে সিদ্ধান্ত নেয় যে সে একটি চাইনিজ ইন্টারনেট কোম্পানী খুলবে।
চাইনিজ ইন্টারনেট কোম্পানী খোলার জন্য তার দুইটি উদ্যোগ পুরোপুরি জলে ভেস্তে গিয়েছিল। তবুও সে থামেনি। শেষবারের উদ্যোগ ব্যর্থ হবার চার বছর পর একদিন সে তার এপার্টমেন্টে তার ২৪ জন বন্ধুকে দাওয়াত করে। সেখানে সে তার বন্ধুদের সাথে তার ইচ্ছা, তার কোম্পানী এবং তার নতুন উদ্যোগ নিয়ে কথা বলে। প্রায় দু’ঘণ্টা ধরে তাদেরকে সবকিছু বোঝানোর পর তাদের মধ্যে ২৩ জন বলেন, “যেখানে তোমার ইন্টারনেট সম্পর্কে কোনো ধারণা নেই সেখানে তুমি এই কাজ কীভাবে করবে? এটা অসম্ভব!”
কিন্তু একজন ব্যক্তি বলেন, “জ্যাক, তুমি যদি এই ব্যাপারটা চেষ্টা করে দেখতে চাও তাহলে দেখতে পারো। কিন্তু কোনো কিছু ভুল হলে এই ব্যাপারটা থেকে চলে আসো।” সেদিনের পর সারারাত জ্যাক মা চিন্তা করেছিলেন তিনি আদোও কিছু করবেন কিনা। কিন্তু ততক্ষণে তিনি সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছিলেন যে তিনি কোম্পানী খুলবেন এবং তিনি তা করে দেখিয়েও দিয়েছিলেন। ১৯৯৯ সালের দিকে তার “আলিবাবা.কম” এর সার্ভিস সারা বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়েছিল। পরবর্তীতে কোম্পানী Golman Sachs এর থেকে ৫মিলিয়ন ডলার এবং Softbank এর থেকে ২০মিলিয়ন ডলার কামিয়েছিল।
“We will make it because we are young and we never, never give up”
২০০৫ সালে “ইয়াহু” ১বিলিয়ন ডলার অফার করেছিল তার কোম্পানীর ৪০% স্ট্যাক এর জন্য। ২০১৩ সালে সালে জ্যাক মা সিইও পোস্ট থেকে সরে এসে এক্সিকিউটিভ চেয়ারম্যান পোস্ট নিয়ে নেন। আর এমন সময় যখন বিশ্বজুড়ে সকল মানুষ “আলিবাবা”র সার্ভিস সানন্দে গ্রহণ করছিল, তখন জ্যাক মা বলেন,
“Today what we got is not money. What we got is the trust from the people.”
তবে যাই হোক না কেন, সাফল্য যে সহজলভ্য জিনিস নয় তা এতক্ষণে নিশ্চয়ই বোঝা হয়ে গেছে। আর এই সাফল্যকে বয়ে নেওয়াটাও কম কষ্টের নয়। জ্যাক মা এর মত একজন উদ্যোক্তাবান মানুষ নিজেও প্রথমবারেই তার স্বপ্ন গুলোকে দাঁড় করাতে পারেননি। পর পর দু’বার তার উদ্যোগ জলে ভেস্তে গেলেও সে দমে যাননি। পুরো দু’ঘণ্টা ধরে কতগুলো মানুষকে তার পরিকল্পনা সম্পর্কে বোঝালেও তারা তাকে বলে এ অসম্ভব। কোনোভাবে করা যাবে না এ কাজ। আর এই “কোনোভাবেই করা যাবে না” কাজটাকে “করা যাবে” তে পরিণত করেছেন।
আর এই অসম্ভবকে সম্ভবে পরিণত করতে তাকে কষ্ট করতে হয়েছে। তার কাজে পরিপূর্ন মনোনিবেশের তাকে তার লোকাল ভার্সিটির সেই শিক্ষকের চাকরীটাও ছাড়তে হয়েছে। ছাড়তে হয়েছে অন্য সব কিছুও। কিন্তু ছাড়েননি তার স্বপ্ন এবং ইচ্ছা। নিয়ে গেছেন সেই স্বপ্নকে পর্বসমান উচ্চতায়। আর তার এই উচ্চতাই এখন বহু উদ্যোক্তার স্বপ্নে পরিণত হয়েছে। আপনার সফলতা যখন অন্যের স্বপ্ন, তখন তার থেকে বড় সফলতা আর কিছু নেই।
তাই সফলতা হওয়া উচিত আপনার ইচ্ছা, আকাঙ্ক্ষা এবং আপনি যা করতে ভালো বাসেন। যেখানে থাকবে আপনার স্বাধীনতা। যেখানে কোনো কিছু করতে আপনাকে বাধ্য করা হবে না। আপনার উপর কোনো নিয়ম জাড়ি করা হবে না। জবাব্দিহিতাও করার প্রয়োজন হবে না। আপনি যা করবেন আপনার স্ব-ইচ্ছায় এবং ভালোবাসায়। তাই জীবনে সফল হতে হলে নিজের মনের কথা শুনতে হবে। নিজেকে বুঝতে হবে।
জ্যাক মা এর মত আরোও অনেক সফল উদ্যোক্তার কথা আমরা জানি আবার অনেলের কথা আমরা জানি না। এমন মানুহগুলো প্রতিনিয়ত আমাদের শেখাচ্ছে কীভাবে একজন সফল উদ্যোক্তা হওয়া যায়। কীভাবে একটি ভুল থেকে উঠে দাঁড়ানো যায়। ঘাড় ঘুরিয়ে কথা বলা যায়। অন্যদের নিষেধাজ্ঞা এড়িয়ে নিজের মনের মত কাজ করা যায়। তাই কখনো থেমে থাকা যাবে না। হাঁটতে হবে অনেকদূর। এই হাঁটার পথে পাথর এলে তাকে সরানোর ব্যবস্থাও করে নিতে হবে। বড় বড় বিপদগুলোকে ডিঙিয়ে চলে যেতে হবে আরো অনেকটা পথ। দূর্গম পথগুলো পার হয়ে চলে যেতে হবে সেই সুগম পথে যেই পথের স্বপ্ন সেই কবে থেকে বুনছেন।