টিকিট কালোবাজারির অভিযোগে অভিযুক্ত ট্রেনের অনলাইন সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান সহজ ডটকম। সম্প্রতি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর চার দফা অভিযানে প্রতিষ্ঠানের অনেক কর্মকর্তার নাম বেরিয়ে আসে। তাদের সঙ্গে যুক্ত রয়েছে রেলের লোকজনও। এমন বাস্তবতায় ঈদযাত্রায় অনলাইনে ট্রেনের শতভাগ টিকিট বিক্রির দায়িত্ব বিতর্কিত প্রতিষ্ঠান সহজের হাতেই রয়ে গেল। সাত দিনে ঢাকা থেকে ২ লাখ ৩৪ হাজার ৫০০ টিকিট বিক্রি করার দায়িত্ব দেওয়া হয় প্রতিষ্ঠানটিকে। যদিও কালোবাজারি প্রতিরোধে রেলের পক্ষ থেকে নেই প্রযুক্তিগত কোনো ব্যবস্থা। নেই নজরদারিও। সব মিলিয়ে সহজের কাছে অসহায় রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ।
জানা গেছে, ২০২২ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি সহজের সঙ্গে চুক্তি করে রেল। শর্ত অনুযায়ী পাঁচ বছরে ২০ কোটি টিকিট বিক্রি করে ৫ কোটি টাকা কমিশন নেবে প্রতিষ্ঠানটি। এই হিসাবে ২০২৭ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি চুক্তির মেয়াদ শেষ হবে। তবে চুক্তিতে ঈদের সময় শতভাগ টিকিট বিক্রির কোনো শর্ত ছিল না। পরবর্তী সময়ে রেল মন্ত্রণালয় উদ্যোগী হয়ে শতভাগ ঈদযাত্রার টিকিট বিক্রির দায়িত্ব প্রতিষ্ঠানটির হাতে তুলে দেয়। লিখিতভাবে প্রতিষ্ঠানটি এ দায়িত্বভার গ্রহণ করে।
চুক্তি করার কারণে সহজের বিরুদ্ধে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নিতে পারছে না রেলওয়ে। তবে নিজেদের স্বচ্ছতা জানান দিতে টিকিট বিক্রির পরদিন অনলাইনে ও ঢাকা রেলওয়ে স্টেশনে তালিকা টানিয়ে দায় সারছে রেলওয়ে।
অথচ প্রতিদিন ৩৩ হাজারের বেশি আন্তঃনগর ট্রেনের টিকিট প্রকৃত যাত্রীদের হাতে যাচ্ছে কি না তা যাচাইয়ের কোনো ব্যবস্থা নেই। সেইসঙ্গে ঈদযাত্রার টিকিটের কত শতাংশ যাত্রী পাচ্ছেন তাও নিশ্চিত হওয়া কঠিন। প্রতিদিনের টিকিট কারসাজি করে রেখে দেওয়া হচ্ছে কি না তাও দেখভালের কেউ নেই। রেলের নিজস্ব প্রযুক্তি বিভাগ না থাকায় সবকিছুর চাবিকাঠি সহজের হাতেই।
অভিযোগ আছে, বিভিন্ন সময়ে কাউন্টারে দেওয়া জাতীয় পরিচয়পত্র সংগ্রহ করে রাখে সহজ ও রেলের একটি চক্র। বিশাল এই এনআইডি তথ্য ভান্ডার দিয়ে একাধিক সিম রেজিস্ট্রেশন করেই মূলত টিকিট সংগ্রহ করে তারা। পরবর্তী সময়ে সেগুলো কয়েকগুণ বেশি দামে বিক্রি হয়। একজন নিবন্ধিত যাত্রী চারটি টিকিট সংগ্রহ করতে পারেন। ১০টি এনআইডির বিপরীতে এক ব্যক্তি একই দিনের ৪০টি টিকিট সংগ্রহ করতে পারেন। প্রয়োজনে আরও বেশি পান। অভিযোগ রয়েছে,সহজের পক্ষ থেকে টিকিট ব্লক করে রাখারও। পরবর্তী সময়ে বাড়তি দামে ক্রেতাদের কাছে তা বিক্রি হয়। সম্প্রতি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে গ্রেপ্তার হওয়া ব্যক্তিরা জিজ্ঞাসাবাদে এসব তথ্য দিয়েছে।
মূলত ঈদযাত্রায় ট্রেনের টিকিটের চাহিদা থাকে সবচেয়ে বেশি। ঈদ বা অন্য যে কোনো উৎসব বা বড় ছুটি ঘিরেই বেশি সক্রিয় থাকে কালোবাজারি চক্র। এনআইডি দিয়ে রেজিস্ট্রেশন বা ওটিপি নিশ্চিত হয়ে ট্রেনের টিকিট কালোবাজারি বন্ধ সম্ভব নয় বলছেন যোগাযোগ বিশেষজ্ঞরা। তাদের পরামর্শ, আপৎকালীন সংকট মোকাবিলায় সব টিকিটে জাতীয় পরিচয়পত্র প্রিন্ট করে ভ্রমণের সময় তা চেক করতে হবে। এমআরটি পাসের মতো ব্যবস্থা নিশ্চিত করা গেলে টিকিট কালোবাজারি ঠেকানো যাবে।
শতভাগ অনলাইনে ট্রেনের টিকিট বিক্রির স্বচ্ছতা প্রসঙ্গে জানতে চাইলে ঢাকা রেলওয়ে স্টেশন ম্যানেজার মাসুদ সারোয়ার বলেন, টিকিট কালোবাজারি ঠেকাতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কাজ করে যাচ্ছে। এরই মধ্যে অনেকেই ধরা পড়েছেন।
তিনি বলেন, কেউ তো আমাদের কাছে এসে টিকিট না পাওয়ার অভিযোগ করেনি। তাছাড়া কারা টিকিট কিনছেন তাদের নাম ও জাতীয় পরিচয়পত্রের নম্বর অনলাইনে আপ করাসহ স্টেশনে প্রিন্ট কপি টানিয়ে দেওয়া হচ্ছে। সব জাতীয় পরিচয়পত্র যাচাই করে টিকিট কলোবাজারি রোধ সম্ভব কি নাÑএমন প্রশ্নে তিনি বলেন, রেল থেকে এ ধরনের ব্যবস্থা ছাড়া আর তো কোনো পদক্ষেপ আমরা দেখছি না।
টিকিট কালোবাজারি বন্ধ নিশ্চিত করতে সহজের পক্ষ থেকে পদক্ষেপের বিষয় জানতে চাইলে প্রতিষ্ঠানটির প্রধান টেকনেশিয়ান সন্দীপ দেবনাথ বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে টিকিট কালোবাজারির অভিযোগে যারা গ্রেপ্তার হয়েছে, এ দায় তাদের ব্যক্তিগত। সহজের সঙ্গে এর কোনো সম্পর্ক নেই। তবে আমরা এ ঘটনার দায় এড়াতে পারি না।
ঈদযাত্রায় শতভাগ স্বচ্ছতার সঙ্গে টিকিট বিক্রি দাবি করে তিনি বলেন, আমরাও কালোবাজারির বিরুদ্ধে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে আমরা নিয়মিত তথ্য সরবরাহ করছি। কারা টিকিট পেলেন এর তালিকা প্রকাশ করা হচ্ছে। ওটিপি নিশ্চিত হয়ে টিকিট বিক্রি হচ্ছে।
মূলত ২০২৩ সাল থেকে ঈদযাত্রায় শতভাগ অনলাইন টিকিট বিক্রির সিদ্ধান্ত নেয় রেল কর্তৃপক্ষ। এ দায়িত্ব নতুন করে নিয়োজিত হয় অনলাইন সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান সহজ। অর্থাৎ ঈদযাত্রায় শতভাগ টিকিট বিক্রির দায়িত্ব প্রতিষ্ঠানটির হাতে। গত বছরের ২৮ এপ্রিল টিকিট কালোবাজারির অভিযোগে সহজের সিস্টেম ইঞ্জিনিয়ার রেজাউল করিমকে আটক করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। এরপর থেকেই প্রতিষ্ঠানটির টিকিট বিক্রির স্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। গত ২৬ জানুয়ারি টিকিট কালোবাজারির সঙ্গে যুক্ত সহজ ও রেলের ১৪ জনকে গ্রেপ্তার করে র্যাব।
সর্বশেষ গত বৃহস্পতিবার ট্রেনের টিকিট কালোবাজারির অভিযোগে টিকিট বিক্রির দায়িত্বপ্রাপ্ত কোম্পানি সহজ ডটকমের অফিস সহকারী মিজান ঢালীসহ ৯ জনকে গ্রেপ্তার করে র্যাব। এ সময় তাদের কাছ থেকে অবৈধভাবে সংগ্রহ করা ট্রেনের ৩ হাজার টিকিট উদ্ধার করা হয়। জানা গেছে, ২০ বছর ধরে এই অপকর্মে যুক্ত মিজান সিন্ডিকেট।
যোগাযোগ বিশেষজ্ঞা ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অধ্যাপক ড. হাদিউজ্জামান বলেন, জাতীয় পরিচয়পত্র ও ওটিপি দিয়ে ট্রেনের টিকিট কালোবাজারি রোধ করা যাবে না। বাংলাদেশ ডিজিটাল হচ্ছে। অথচ রেলে একটি আইসিটি ডিভিশন গড়ে ওঠেনি। থার্ড পার্টির ওপর নির্ভর করে টিকিট ব্যবস্থাপনা করতে হচ্ছে। এটি খুবই দুঃখজনক। টিকিট যদি থার্ড পার্টি পায় তাহলে সব ট্রেন পরিচালনার দায়িত্বও থার্ড পার্টিকে দেওয়া উচিত। তাহলে কোম্পানি লাভের কথা চিন্তা করে টিকিট কালোবাজারি প্রতিরোধ করবে।
তিনি আরও বলেন, ঈদযাত্রায় ট্রেনের টিকিটের চাহিদা অনেক। এক হাজারে হয়তো একজন টিকিট পাচ্ছেন। কিন্তু একজন ব্যক্তির হাতে কোনো রকম কারসাজি ছাড়া টিকিট যাচ্ছে, তা নিশ্চিত হওয়ার সুযোগ নেই। রেল ও সহজের নিজস্ব লোকদের হাতে অনেক এনআইডি আছে। মোবাইল ফোনের অভাব নেই। ফলে বিদ্যমান ব্যবস্থায় টিকিট কালোবাজারি ঠেকানো যাবে না। ভবিষ্যতে এমআরটি পাসের মতো ব্যবস্থা করতে হবে। যাত্রী এমআরটি পাস স্ক্যান করলেই ট্রেনের দরজা খুলে যাবে। একজনের পাস দিয়ে অন্যজন ভ্রমণ করতে পারবে না। তাছাড়া প্রতিদিন ৩৩ হাজার টিকিটের তালিকা ধরে কালোবাজারি চিহ্নিত করা কঠিন বলেও মনে করেন তিনি।