বছর দুয়েক আগের কথা। পবিত্র ঈদুল ফিতর উপলক্ষে ট্রেনের অগ্রিম টিকিট কিনতে সাহ্রি খেয়েই লোকজন চলে আসতেন কমলাপুর রেলস্টেশনে। উপচে পড়া ভিড়ে দীর্ঘ অপেক্ষার পর মিলত টিকিট। ট্রেনের অগ্রিম টিকিট অনলাইনে বিক্রির কারণে এখন সেই চিত্র বদলেছে। তবে টিকিট পেতে এখন মানুষকে ‘যুদ্ধ’ করতে হচ্ছে অনলাইনে। টিকিট ছাড়ার প্রথম আধা ঘণ্টায় এক কোটির কাছাকাছি বার টিকিট কাটার চেষ্টা বা হিট হয়েছে।
এখন বাসের অগ্রিম টিকিটও অনলাইনে কিনতে পারছেন যাত্রীরা। ফলে মানুষের ভোগান্তিও কমেছে। কিছু পরিবহনের কাউন্টারে অগ্রিম টিকিট কাটার সুযোগ থাকলেও ঢাকার বাস কাউন্টারগুলোতে গতকাল বৃহস্পতিবার পর্যন্ত ভিড় দেখা যায়নি।
ঈদ উপলক্ষে ঢাকা-বরিশাল নৌপথে ৬ এপ্রিল বিশেষ লঞ্চ সার্ভিস শুরু হবে। তবে ঢাকা থেকে অগ্রিম টিকিট নেওয়ার তেমন তোড়জোড় নেই। সদরঘাটের লঞ্চ কাউন্টারগুলো অনেকটাই ফাঁকা। লঞ্চের মালিক ও কর্মচারীদের ভাষ্য, পদ্মা সেতু চালু হওয়ার পর দক্ষিণাঞ্চলের যাত্রীরা সড়কপথকে প্রাধান্য দিচ্ছেন। তাই লঞ্চে আগের মতো যাত্রী পাওয়া যাচ্ছে না। ঈদ উপলক্ষেও যাত্রীর তেমন চাপ নেই।
অন্যদিকে ঈদুল ফিতরের আগের কয়েক দিনের অভ্যন্তরীণ গন্তব্যের ফ্লাইটের অধিকাংশ টিকিট এরই মধ্যে বিক্রি হয়ে গেছে। যাত্রীদের বড় অংশ অনলাইনে ক্রেডিট কার্ড ও মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে টিকিট কিনে থাকেন। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, উড়োজাহাজের সাশ্রয়ী আসনের টিকিট অনেক আগেই অনলাইনে বা অ্যাপে বিক্রি হয়ে গেছে। যেসব টিকিট এখনো অবিক্রীত আছে, সেগুলোর দাম দুই থেকে তিন গুণ বেশি।
ট্রেনের টিকিটের জন্য ভিন্ন রকম লড়াই
ট্রেনের অগ্রিম টিকিটের শতভাগ অনলাইনে বিক্রি করা হলেও সেটা চাহিদার তুলনায় কম। প্রতিদিন যে পরিমাণ টিকিট অনলাইনে ছাড়া হয়, টিকিটপ্রত্যাশী থাকেন তার চেয়ে অনেক বেশি। বিশেষ করে সকালে ট্রেনের টিকিট বিক্রি শুরু হওয়ার প্রথম আধঘণ্টায় একেকটি টিকিট পেতে গড়ে ৬০০ জন চেষ্টা চালান।
রেলওয়ে সূত্র বলছে, গতকাল বিক্রি হয়েছে ৭ এপ্রিলের টিকিট। এদিন সকালে ট্রেনের পশ্চিমাঞ্চলে টিকিট বিক্রি শুরুর প্রথম আধঘণ্টায় ৯৪ লাখ বার এবং বিকেলে পূর্বাঞ্চলের টিকিট বিক্রির প্রথম আধঘণ্টায় ৭৪ লাখ ৫০ হাজার হিট হয়েছে। এর আগে পশ্চিমাঞ্চলের টিকিটের জন্য সকালের প্রথম আধঘণ্টায় কোটির আশপাশে এবং পূর্বাঞ্চলে প্রথম আধঘণ্টায় ৫০ লাখের মতে হিট হয়েছে।
রেলের কর্মকর্তারা বলছেন, প্রতিদিন কমপক্ষে চার লাখ টিকিটের চাহিদা থাকে। আন্তনগর ট্রেনের ৩০ হাজারের কিছু বেশি টিকিট প্রতিদিন বিক্রি করা হচ্ছে। ফলে অনেকে টিকিট পাচ্ছেন না।
একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের বিক্রয় বিভাগের নির্বাহী ব্যবস্থাপক আহমেদ সুমনের বাড়ি জামালপুরের দেওয়ানগঞ্জে। ঈদে বাড়ি যাওয়ার জন্য তিনি সব সময় তিস্তা এক্সপ্রেসের টিকিট কাটেন। আহমেদ সুমন প্রথম আলোকে বলেন, ‘আগে কয়েকজন মিলে রাতে রেলস্টেশনে চলে যেতাম। মশার কামড় খেয়ে রাত জেগে কয়েক ঘণ্টা পার করতাম। তারপরও অনেক সময় টিকিট পেতাম না। এখন অনলাইনে যেকোনো জায়গা থেকে টিকিট কাটা যায়। তবে অনেক সময় অ্যাপে প্রবেশ করা যায় না।’
এবার ঈদুল ফিতর উপলক্ষে ২৪ মার্চ ট্রেনের অগ্রিম টিকিট বিক্রি শুরু হয়েছে। চলবে ৩০ মার্চ পর্যন্ত। চাঁদ দেখা সাপেক্ষে ১১ এপ্রিল ঈদ হবে ধরে নিয়ে এবারের ঈদযাত্রার সূচি সাজিয়েছে বাংলাদেশ রেলওয়ে।
ঢাকা মেডিকেলের ছাত্রী তানাজ্জাতুল ইসলাম ঈদে ঢাকা থেকে কক্সবাজার যাবেন। তিনি ৩১ মার্চের ট্রেনের অগ্রিম টিকিট কেনেন ২৪ মার্চ। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘অনলাইনে টিকিট করতে কোনো ভোগান্তি হয়নি। অনলাইনে টিকিটের জন্য যখন প্রবেশ করি, তখনো ৫১টি টিকিট ফাঁকা ছিল। আগে একটি টিকিটের জন্য অনেক হয়রানি হতো।
ঈদযাত্রায় ট্রেনের শতভাগ টিকিট অনলাইনে বিক্রি শুরু হয় গত বছর। রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ বলছে, ঈদের টিকিটের জন্য ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে থাকার দুর্ভোগ কমাতে এবং কালোবাজারি বন্ধে এ উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। টিকিট বিক্রির দায়িত্বে রয়েছে অনলাইন সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান সহজ ডটকম।
এ ছাড়া অনলাইন টিকিট বিক্রি হলেও যাত্রীদের অনেকের অভিযোগ, অনলাইনে সবাই টিকিট পাচ্ছেন না। নির্ধারিত গন্তব্য ও ট্রেনের আসন ফাঁকা রয়েছে দেখালেও সেই টিকিট কাটতে সমস্যায় পড়তে হচ্ছে।
রেলওয়ে ও সহজ ডটকমের কর্মকর্তারা বলছেন, একটি টিকিটের বিপরীতে একসঙ্গে অনেকে কেনার চেষ্টা করছেন। তাঁদের মধ্যে একজন সফল হলেও অন্যরা টিকিট পাচ্ছেন না।
বাসের ৬০ শতাংশ টিকিট অনলাইনে
ট্রেনের মতো বাসের অগ্রিম টিকিটও অনলাইনে বিক্রি হচ্ছে। ফলে ঈদযাত্রায় বাসের অগ্রিম টিকিট বিক্রি শুরু হলেও টার্মিনালগুলোতে যাত্রীর উপচে পড়া ভিড় নেই।
অনলাইনে বাসের টিকিট বিক্রির বিষয়ে কথা হয় বাংলাদেশ বাস-ট্রাক ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের চেয়ারম্যান ও শ্যামলী পরিবহনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক রমেশ চন্দ্র ঘোষের সঙ্গে। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, বড় কোম্পানিগুলো নিজেদের বাসের ৬০ থেকে ৭০ শতাংশ টিকিট অনলাইনে বিক্রি করছে। যাত্রীদের সুবিধার কথা বিবেচনা করেই এমন ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। যাত্রীদের বাস কাউন্টারে যাতায়াতের ভাড়া খরচ করতে হচ্ছে না।
অনলাইনে টিকিট বিক্রির বিষয়টিকে ইতিবাচক বলে মনে করছে যাত্রী অধিকার নিয়ে কাজ করা সংগঠনগুলো। রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক সাইদুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ঈদযাত্রায় ট্রেন ও বাসের টিকিট নিয়ে যাত্রীদের হয়রানি অনেকটা কমেছে। তবে যাঁদের অনলাইনে টিকিট কেনার মতো কারিগরি জ্ঞান বা ডিভাইস নেই, তাঁরা যেন বঞ্চিত না হন; সেটিও নিশ্চিত করতে হবে। একই সঙ্গে টিকিট নিয়ে ডিজিটাল কালোবাজারির সুযোগ বন্ধে কর্তৃপক্ষকে তৎপর থাকতে হবে।