আগামী চার বছরে ই-কমার্সের বাজার আরও প্রায় ৪০০ কোটি ডলার বাড়বে। বর্তমান বাজারদরে এর পরিমাণ প্রায় ৪১ হাজার কোটি টাকা। ২০২২ সাল শেষে ই-কমার্সের বাজারের আকার ছিল ৬৬০ কোটি ডলার। এই বাজার আগামী চার বছরে আরও বাড়বে। ২০২৬ সাল নাগাদ তা বেড়ে দাঁড়াতে পারে ১ হাজার ৫০ কোটি ডলার। বর্তমান বাজারদরে এর পরিমাণ ১ লাখ ২০ হাজার কোটি টাকার বেশি।
বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)-এর একটি গবেষণার হিসাব দিয়ে ই-কমার্সের বাজার সম্প্রসারণের সম্ভাবনার এ চিত্র তুলে ধরা হয়েছে সম্প্রতি। ফেসবুকে সক্রিয় এমন দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ তৃতীয় বৃহত্তম দেশ। ২০২৭ সালে ওটিটি প্ল্যাটফরম ব্যবহারকারীর সংখ্যা দাঁড়াবে ১ কোটি ১৩ লাখ। ফ্রিল্যান্সিং থেকে আয়ে শীর্ষ ১০টির মধ্যে বাংলাদেশ অষ্টম। ফেসবুক, গুগল, অ্যামাজনের মতো অনাবাসী প্রতিষ্ঠানগুলো বাংলাদেশে এসেছে। ভবিষ্যতে বাংলাদেশে এর ব্যবসা সম্প্রসারিত হবে। নাগরিকেরা ফেসবুকে বেশ সক্রিয় এমন দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম দেশ। এই সূচকে ভারত ও ফিলিপাইন প্রথম ও দ্বিতীয় স্থানে আছে। করোনা মহামারির ভয়াবহ প্রকোপের মধ্যে ব্যবসা বেড়েছে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য সরবরাহকারী ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলোর। মহামারি করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে সরকার ঘোষিত কঠোর বিধিনিষেধ চলাকালে ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলোর পণ্য ভেদে সর্বোচ্চ প্রবৃদ্ধি ৩০০ শতাংশ পর্যন্ত পৌঁছেছে।
করোনাকালীন যেখানে অনেক ব্যবসা, অনেক প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেছে সেখানে ই-কমার্সের অনেক প্রতিষ্ঠান অতীতের চেয়ে কয়েক গুণ বেশি পণ্য ডেলিভারি দিয়েছে। এর মাধ্যমে নতুন করে কর্মসংস্থান হয়েছে ৫০ হাজার মানুষের। মূলত করোনাকালীন ক্রেতাদের চাহিদা বৃদ্ধির প্রেক্ষিতে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানগুলো সবচেয়ে বেশি ভালো করছে। নিত্যপণ্য ও খাদ্যসামগ্রী ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত প্রতিষ্ঠানগুলো ক্ষেত্রবিশেষে ৩০০ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে। করোনা মহামারির সময় ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলো ভালোভাবে ব্যবসা পরিচালনা করার সুযোগ পেয়েছে। ফলে ব্যবসার প্রবৃদ্ধিও ঘটেছে উল্লেখযোগ্য হারে। শহরাঞ্চলের অনেক মানুষ আজকাল অনলাইন কেনাকাটায় বেশ অভ্যস্ত হয়ে গেছেন। করোনা মহামারির প্রকোপে বিশ্বব্যাপী ই-কমার্সের ক্ষেত্রে নতুন সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। বাস্তব প্রয়োজনেই এখন মানুষ ই-কমার্সের শরণাপন্ন হচ্ছেন। এক্ষেত্রে দারুণ গতির সঞ্চার করার পেছনে বড় কারণ হলো, মানুষ এখন দোকানে দোকানে ঘুরে কেনাকাটা বা বাজার করার চেয়ে ই-কমার্সের মাধ্যমে ঘরে বসে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য ক্রয়টিকে অনেক বেশি নিরাপদ বলে মনে করছেন। মহামারির কারণে বিশ্ব জুড়ে অধিকাংশ ভোক্তা ঘরের বাইরে বের হননি। তাই নিত্যপ্রয়োজনীয় মুদি পণ্য থেকে শুরু করে বাগানের জিনিসপত্র—সবই তাদের কিনতে হয়েছে অনলাইন থেকে।
দেশীয় বাজারে ই-কমার্সে বেশি কেনা বেচা হয় ফ্যাশন অর্থাৎ জামাকাপড়, শাড়ি, জুতো, খাবার-দাবার, জুয়েলারি, ও ইলেকট্রনিক পণ্য। এগুলোর লেনদেন হয় নগদ টাকায় এবং অনলাইন পেমেন্ট সিস্টেমে। ই-কমার্সের দেশীয় বাজার প্রসারিত হচ্ছে, কিন্তু আন্তর্জাতিক বাজার ধরতে হলে সঠিক নীতিমালা প্রণয়ন করতে হবে। তা না হলে প্রতিবেশী দেশের ই-কমার্স উদ্যোক্তারা বাজার দখল করবে। ই-কমার্সের বিস্তৃতির জন্য সরকারকে আরও সচেষ্ট হতে হবে। কারণ সরকারিভাবে ব্যবসা বাণিজ্য আর্থিক লেনদেনে ডিজিটাল প্রযুক্তির সর্বোচ্চ ব্যবহারকে উৎসাহিত করা হচ্ছে। এখনো ই-কমার্স নিয়ে সরকারিভাবে কোনো নীতিমালা প্রণীত হয়নি। নীতিমালা না থাকার কারণে ই-কমার্সে প্রতারণা, জালিয়াতি, অনিয়ম হলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ সম্ভব হচ্ছে না। এর ফলে আস্থার ঘাটতি তৈরি হতে পারে। যা ই-কমার্সের বিকাশের পথে বিরাট বাধা হয়ে উঠতে পারে। ডিজিটাল অর্থনীতি থেকে কর আদায় বাড়াতে হলে রাজস্ব প্রশাসনের সংস্কার প্রয়োজন। আবার কর সুবিধা যৌক্তিকভাবে দিতে হবে। ডিজিটাল অর্থনীতির আকার বৃদ্ধির সঙ্গে এ খাত থেকে কর আদায়ে জোর দেওয়া দরকার। ডিজিটাল অর্থনীতির সম্প্রসারণ হলেও কাঙ্ক্ষিত কর আদায় করা যাচ্ছে না। কর দেওয়ার পদ্ধতি সহজ করলে ভালো ফল পাওয়া যাবে। হয়রানি বন্ধ করতে হবে। এছাড়া ফেসবুক, গুগল, অ্যামাজনের মতো অনাবাসী প্রতিষ্ঠানের কাছে কর আদায়ের উদ্যোগ নিতে হবে। ফেসবুক, গুগল, অ্যামাজনের মতো অনাবাসী প্রতিষ্ঠানগুলো বাংলাদেশে এসেছে। ভবিষ্যতে বাংলাদেশে এর ব্যবসা সম্প্রসারিত হবে।
২০২১-২২ অর্থবছরে ফেসবুক, গুগল, অ্যামাজনসহ ৯টি অনাবাসী প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে মাত্র ৫৮ কোটি টাকার মতো ভ্যাট পেয়েছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। সব মিলিয়ে কর মিলেছে ৩৮৫ কোটি টাকা। গুগল, ফেসবুক, অ্যামাজনসহ ইন্টারনেটভিত্তিক প্রতিষ্ঠানগুলো ডিজিটাল বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে বাংলাদেশ থেকে বছর ২ হাজার কোটি টাকা নিয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের ২০১৯ সালের হিসাবে, দেশের পাঁচটি মোবাইল ফোন অপারেটর প্রতিষ্ঠান আগের পাঁচ বছরে গুগল, ফেসবুকের মতো প্রতিষ্ঠানকে ৮ হাজার ৭৫০ কোটি টাকার ডিজিটাল বিজ্ঞাপন দিয়েছে। কিন্তু এনবিআরের হিসাব বলছে, মাত্র ১৩৩ কোটি টাকার বিজ্ঞাপন দেওয়া হয়েছে। ওভার দ্য টপ (ওটিটি) প্ল্যাটফরম থেকে ২০২৩ সালে বাংলাদেশ ১৫ কোটি ২৭ লাখ ডলার পাবে এবং ২০২৭ সাল নাগাদ এই প্ল্যাটফরম ব্যবহারকারীর সংখ্যা দাঁড়াবে ১ কোটি ১৩ লাখ। নেটফ্লিক্সের বাংলাদেশে গ্রাহকসংখ্যা এখন ২ লাখ। বছরে আয় ২০০ কোটি টাকা। চরকি, বায়োস্কোপ, টফির মতো দেশি ওটিটি প্ল্যাটফরমও আছে। ফ্রিল্যান্সিং থেকে আয়ে শীর্ষ ১০টির মধ্যে বাংলাদেশ অষ্টম। বর্তমানে তথ্যপ্রযুক্তি খাতে কর অবকাশ-সুবিধা, নগদ সহায়তাসহ নানা প্রণোদনা দেয় সরকার। তবে আগামী জুন মাসে তথ্যপ্রযুক্তি খাতের কর অবকাশ-সুবিধা উঠে যাচ্ছে। তবে ডিজিটাল প্ল্যাটফরম ব্যবহার করে পণ্য বা সেবা বিক্রিতে ১৫ শতাংশ ভ্যাট আছে। ফেসবুক, গুগলের মতো প্রতিষ্ঠানগুলোর ‘ছায়া’ আছে; কিন্তু বডি নেই। এ দেশে এসব প্রতিষ্ঠানের অফিস থাকতে হবে। ডিজিটাল অর্থনীতি থেকে কর আদায় বাড়াতে হলে কর প্রশাসনকে দক্ষ করতে হবে।
তবে ডিজিটাল অর্থনীতিতে কোথা থেকে আয় সৃষ্টি হচ্ছে, তা অনেক সময় জানা যায় না। ফলে কর আদায় কঠিন হয়ে পড়ে। ঝামেলাহীনভাবে শুল্ক-কর দেওয়ার ব্যবস্থা গড়ে তুলতে পারলে তথ্যপ্রযুক্তি খাতে অনেক উদ্যোক্তা গড়ে উঠবে।