রাজধানীর কাঁঠালবাগান ঢালের বাসিন্দা বেসরকারি চাকরিজীবী কেফায়েত উল্লাহ নতুন বছরের শুরুতে বাড়িভাড়া বৃদ্ধির নোটিশ পেয়েছেন। দেড় হাজার বর্গফুটের তিন রুমের ফ্ল্যাটের ভাড়া ২৫ হাজার টাকা থেকে বেড়ে হয়েছে ২৭ হাজার টাকা। তাতে নতুন বছরের শুরুতে কেফায়েত উল্লাহ জীবনযাত্রার খরচ আরেক দফা বাড়ল। এতে দুশ্চিন্তায় পড়েছেন তিনি।
কেফায়েত উল্লাহ বলেন, ‘গত কয়েক বছরে ঢাকায় যে বাসাতেই থেকেছি, বছরের শুরুতে সবখানে ভাড়া বাড়ানো হয়েছে। এবারও ব্যতিক্রম হয়নি। কিন্তু বাসা ভাড়া যে হারে বেড়েছে, সেই হারে বেতন বাড়ছে না। আবার দ্রব্যমূল্যের অস্বাভাবিক ঊর্ধ্বগতিতে গত বছর বাজার খরচও দফায় দফায় বেড়ে এমন পর্যায়ে গেছে—এখন আর পণ্যতালিকায় কাটছাঁট করারও জায়গা নেই। এ অবস্থায় নতুন করে বাসাভাড়া বেড়ে যাওয়ায় জীবনযাত্রার ওপর বেশ চাপ তৈরি হলো।’
দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, গ্যাস, বিদ্যুৎ, পানির দামসহ জীবনযাত্রার খরচ মেটাতে এমনিতেই সাধারণ মানুষ হিমশিম খাচ্ছেন। এর মধ্যে রাজধানীর অধিকাংশ এলাকায় বাসাভাড়া বাড়ছে নতুন করে। বছরের শুরুতেই এলাকাভেদে বাসাভাড়া বেড়েছে ৫০০ থেকে ৩ হাজার টাকা পর্যন্ত। কোথাও কোথাও ফ্ল্যাটের আকারভেদে ভাড়া বেড়েছে ৫ হাজার টাকাও। যাঁরা ভাড়া বাসায় থাকেন, তাঁদের আয়ের একটা বড় অংশ চলে যায় মাস শেষে বাসাভাড়ায়।
সাধারণত মানুষের খরচের তুলনায় আয় বেশি বাড়লে তাতে খরচ বাড়লেও মানুষের তেমন সমস্যা হয় না। কিন্তু দেশে গত দেড় বছর মূল্যস্ফীতির চেয়ে মানুষের মজুরি বৃদ্ধির হার কম। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো বা বিবিএসের হিসাব অনুযায়ী, ২০২২ সালের মে মাস থেকে প্রতি মাসে যত মূল্যস্ফীতি হয়েছে, এর চেয়ে কম হারে মজুরি বেড়েছে। গত নভেম্বরে জাতীয় মজুরি বৃদ্ধির হার ছিল ৭ দশমিক ৭২ শতাংশ। তার বিপরীতে সার্বিক মূল্যস্ফীতি ছিল ৯ দশমিক ৪৯ শতাংশ। অর্থাৎ মজুরি যত বেড়েছে, তার চেয়ে বেশি বেড়েছে জীবনযাত্রার ব্যয়।
রাজধানীর উত্তরা, মিরপুর, মোহাম্মদপুর, বসিলা, পল্টন, বাড্ডা (সাতারকুল), মহানগর আবাসিক, মগবাজার, ইস্কাটন, বাংলামোটর, কাঁঠালবাগান ও পান্থপথ এলাকার ১২টি পরিবারের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, নতুন বছর শুরুর আগেই অনেক বাড়িওয়ালা বা ফ্ল্যাটমালিক বাসাভাড়া বাড়ানোর নোটিশ দিয়েছে। জানুয়ারি মাস থেকে বাড়তি এ ভাড়া আদায় করা হচ্ছে।
রাজধানীর বাড্ডা এলাকার কলেজশিক্ষক মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, প্রতিবছর বাসাভাড়া এক হাজার করে বাড়ে। এবার বাড়ানো হয়েছে দেড় হাজার টাকা। এটা নিয়ে কথা বলতে গেলে বরং বাড়তি ভাড়ায় না থাকতে চাইলে বাসা ছেড়ে দেওয়ার কথা বলা হয়। চাইলেই হুট করে বাসা বদল সম্ভব না। তাই বাড়তি ভাড়া মেনে নিতে হয়েছে।
এদিকে বাসাভাড়া বাড়ানোর ক্ষেত্রে বাড়ি বা ফ্ল্যাটের মালিকেরা নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধি, গৃহঋণের সুদ, রক্ষণাবেক্ষণ খরচ বৃদ্ধিসহ নানা যুক্তি দেখান। রাজধানীর আশকোনা এলাকার একটি বাড়ির মালিক অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা এম এ মালেক ভূঁইয়া। তিনি মনে করেন, সবাই বাড়িভাড়া বাড়ান না। তবে বাড়িভাড়ার সঙ্গে পরিষেবার খরচও যুক্ত থাকে। সরকার যখন পরিষেবার খরচ বাড়িয়ে দেয়, তখন সেটা বাড়িভাড়ার সঙ্গে সমন্বয় করা হয়।
বিবিএসের হিসাবে, সদ্য বিদায়ী ২০২৩ সালের জানুয়ারি থেকে নভেম্বর পর্যন্ত মূল্যস্ফীতির হিসাব পাওয়া গেছে। এই ১১ মাসে গড় মূল্যস্ফীতি ছিল ৯ দশমিক ৪৮ শতাংশ। তার মানে হলো ২০২২ সালে একজন মানুষের যাবতীয় খরচ যদি ১০০ টাকা হয়, তাহলে ২০২৩ সালে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১০৯ টাকা ৪৮ পয়সায়।
অর্থাৎ প্রতি ১০০ টাকায় খরচ বেড়েছে ৯ টাকা ৪৮ পয়সা। এখন কোনো পরিবারের যদি ২০২২ সালে প্রতি মাসে গড়ে ৩০ হাজার টাকা বাজার খরচ হয়, তাহলে ২০২৩ সালে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩২ হাজার ৮৪৪ টাকা। সেই হিসাবে প্রতি মাসে খরচ বেড়েছে ২ হাজার ৮৪৪ টাকা। অর্থনীতিবিদেরা মনে করেন, মূল্যস্ফীতির বাড়তি চাপ গরিব মানুষকে বেশি ভোগাচ্ছে। এখন বাড়তি বাসাভাড়া সংসার খরচের চাপ আরেক দফা বাড়াবে।
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন তালিকা অনুযায়ী, মিরপুর ২ নম্বর এলাকায় মূল সড়কের পাশে বাড়ির ভাড়া বর্গফুটপ্রতি সর্বোচ্চ সাড়ে ছয় টাকা। সে হিসাবে এক হাজার বর্গফুটের একটি বাড়ির ভাড়া হওয়ার কথা সাড়ে ছয় হাজার টাকা। যদিও করপোরেশনের বেঁধে দেওয়া এ ভাড়া কোথাও মানা হয় না। মিরপুর এলাকায় মূল সড়কের পাশে এক হাজার বর্গফুটের একেকটি বাসার ভাড়া ২০ থেকে ২২ হাজার টাকা।
বাংলাদেশ ভাড়াটিয়া ফেডারেশন ও ভাড়াটিয়া পরিষদের সভাপতি বাহারানে সুলতানবলেন, কোনো নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে ইচ্ছেমতো বাসাভাড়া বাড়ানো হয়। সরকারও এ ব্যাপারে আন্তরিক নয়। তাই ভাড়াটেদের সচেতনতা ছাড়া অন্য কোনো উপায়ে এই পরিস্থিতির পরিবর্তন হবে না।
আইন আছে, প্রয়োগ নেই
বাড়িভাড়া নিয়ন্ত্রণে দেশে একটি আইন আছে। সেটি ১৯৯১ সালের। ভাড়াটেদের স্বার্থ রক্ষায় অনেক কথা উল্লেখ আছে এই আইনে। কিন্তু বাস্তবে এই আইনের তেমন কোনো প্রয়োগ নেই। ১৯৯১ সালে করা এ আইন বাস্তবায়নে এখনো কোনো বিধি করেনি সরকার। বাড়িভাড়া নিয়ন্ত্রণ আইন, ১৯৯১ কার্যকর করতে ২০১০ সালে হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশ (এইচআরপিবি) নামের একটি সংগঠন জনস্বার্থে হাইকোর্টে রিট আবেদন করেছিল।
রিট আবেদনটির পরিপ্রেক্ষিতে রুল ও চূড়ান্ত শুনানি শেষে ২০১৫ সালের ১ জুলাই আদালত রায় দেন। রায়ে বলা হয়, বিদ্যমান আইনটি কার্যকর না হওয়ায় ভাড়াটেদের সুরক্ষা দেওয়া যাচ্ছে না। আইনটি কার্যকরে রাষ্ট্রকে যথাযথ উদ্যোগ নিতে হবে, অন্যথায় সাধারণ মানুষ এ থেকে পরিত্রাণ পাবেন না। রায়ে সারা দেশে এলাকাভেদে সর্বোচ্চ ও সর্বনিম্ন বাড়িভাড়া নির্ধারণের জন্য সরকারকে একটি উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন কমিশন গঠনের নির্দেশ দেন হাইকোর্ট।
কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান প্রথম আলোকে বলেন, বাড়িভাড়া নির্ধারণের বিষয়টি কিছুটা জটিল। তাই এর সমাধানও সহজ নয়। এ জন্য এটা নিয়ে অনেক কথাবার্তা হলেও কাজের কাজ কিছু হয়নি। বিদ্যমান আইনটিও কার্যকর হয়নি। এটা কীভাবে কার্যকর করা যায়, তা ভেবে দেখা প্রয়োজন।