বাটা একটি বহুজাতিক জুতা প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান। বাংলাদেশ তথা সারাবিশ্বে জুতা জগতে সবচেয়ে বিশ্বস্ত ব্রান্ড। জুতা শিল্প জগতে বিশ্বজোড়া পুরনো ও খ্যাতিমান এই কোম্পানি সৃষ্টির ইতিহাস, বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে যাওয়ার গল্প ও ৭১’র মুক্তিযুদ্ধে বাটার ভুমিকা এবং বাংলাদেশে বাটার বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে জানা অজানা তথ্য গুলো দেখে নেওয়া যাক।
বাটার সৃষ্টি, চড়াই-উতরাই ও ছড়িয়ে যাওয়া
বাটার প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন চেক প্রজাতন্ত্রের টোমাস জে বাটা। তার নামানুসারেই কোম্পানির নাম হয় বাটা। টোমাস বাটার পরিবার ছিল মুচির পেশায় নিয়োজিত। তাদের পরিবারের প্রায় ৩০০ বছরের বেশি সময় ধরে ৮ প্রজন্ম জুড়ে একমাত্র পেশা ছিল জুতা সেলাই ও তৈরি করা। টমাস বাটা ছোট থেকে বড় হয়েছেন চামড়া জুতার সাথে খেলাধুলা করে।পূর্বপুরুষের পেশাটাকে ছোট পরিসর থেকে বড় বড় পরিসরে উন্নিত করার নিমিত্তে ১৮৯৪ সালের ২৪ আগস্ট টমাস জে বাটা আর তার ভাই এনটোনিন বাটা ও বোন এনাকে সাথে নিয়ে জিলিন শহরে একটি ছোট্ট দোকান ভাড়া নেয়। তখন তাদের হাতে মাত্র ৩২০ ডলার পূজি। তারা এই পুজিকে সম্বল করে কিস্তিতে সেলাই মেশিন কিনে টি এন্ড এ বাটা (T & A bata) নামে জুতার কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করে জুতা প্রস্তুত শুরু করেন।তার পরের বছরেই ১৮৯৫ সালে টমাসের বড় ভাইয়ের চাকরিতে যোগদান এবং বোন এনার বিয়ে হয়ে যাওয়ায় তারা ব্যবসা ছেড়ে চলে যায়। আবার একই বছর বাটা কোম্পানি আর্থিক সংকটে ধুকতে শুরু করে। ১৯ বছর বয়সী টমাসের বাটা কোম্পানি শুরু না হতেই শেষের উপক্রমে এসে পড়ে।
কিন্তু তরুন টমাস দমে না গিয়ে উত্তরণের পথ খুজে, সিদ্ধান্ত নেয় যে বাটা কোম্পানি প্রচলিত ডিজাইনের বাইরে নতুন ডিজাইনের জুতো বানাবে এবং বাটা তাদের প্রথম ব্রান্ড জুতা “বাটোভকা” বাজারে আনে। এই জুতা বাটার ভবিষ্যৎই পরিবর্তন করে দেয়। বাটার জুতা জনপ্রিয়তা পেতে শুরু করে এবং সেই সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়তে থাকে কোম্পানির কর্মী সংখ্যা, প্রথমে ১০ জন এরপর তা বৃদ্ধি পেয়ে ৫০জন। তবে বাটা কোম্পানির সামনে আরো একটি চ্যালেঞ্জ হাজির হয় তা হচ্ছে পশ্চিমা দেশগুলোর মেশিন চালিত জুতার কাছে বাটা কোম্পানি মার খেতে শুরু করে। এই সমস্যা সমাধানের জন্য ১৯০৪ টমাস তার বিশস্ত ও দক্ষ তিনজন কর্মীসহ আমেরিকায় পাড়ি জমায় আর সেখানে গিয়ে সেখানকার মেশিনচালিত বিখ্যাত এক জুতা কোম্পানিতে চাকুরি নেয়। সেখানে তারা মেশিনের মাধ্যমে কিভাবে জুতা বানায় তা শিখতে থাকতে। সবকিছু শেখা শেষে ছয় মাস পর ফিরে বাটা কোম্পানি ইউরোপে প্রথম মেশিন চালিত জুতা বানানো শুরু করে এবং আধুনিক জুতা শিল্পের সুচনা করে। এর ফলে বাটার জুতার কোয়ালিটি আর উৎপাদন দুটোই বৃদ্ধি পায় যার ফলে বাটা ধীরে ধীরে জুতা শিল্পের ধারক হওয়ার পথে এগিয়ে যেতে থাকে। বাটা জিলিন শহরে প্রথম জুতার এক্সক্লুসিভ স্টোর চালু করে।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন সময় বাটা কোম্পানি সেনাদের জুতা সরবরাহের কাজ পায় যা তারা সফলতার সাথে সম্পন্ন করে। জুতা সরবরাহের পর বেচে যাওয়া কাঁচামাল দিয়ে বাটা কোম্পানি গরীবদের জন্য সস্তা দামের জুতা বাজারে ছাড়ে যার জন্য বাটার জনপ্রিয়তার পালে বেশ বাতাস জোগানের কাজ করে। ১৯১৮ সালে বিশ্বযুদ্ধ শেষ হলে সারা ইউরোপ জুড়ে মন্দাভাব শুরু হয়। এর ফলে কোম্পানি ক্রমাগত লস দিতে শুরু করে। কর্মী ছাটাইয়ে উপক্রম হয়। এ অবস্থা থেকে উন্নতির জন্য টমাস যে বাটা এক সাহসী সিদ্ধান্ত নেয়, জুতার দাম অর্ধেক করে দেয়। যা বাটা কোম্পানিকে জীবন-মরণ প্রশ্নের সম্মুখীন করে। সবাই তাকে মুর্খ বলে উপহাস করতে শুরু করলেও বাটা কোম্পানি তাদের নিবেদিত কর্মীদের নিয়ে উৎপাদন চালিয়ে যেতে থাকে। বাটার এই সাহসী সিদ্ধান্তের ফল আশ্চর্য জনক ভাবে পেতে শুরু করে। চারিদিকে মন্দাভাব চলার পরও বাটার অর্ধেক দামের জুতো কেনার জন্য সবাই হুমড়ি খেয়ে পড়ে। বাটা জুতার চাহিদা এত বেড়ে যায় যে বাটা কোম্পানি বাধ্য হয় তাদের উৎপাদন ১০গুন বৃদ্ধি করার জন্য। ধীরে ব্যাবসার বিস্তার করতে থাকে। বর্তমানে কোম্পানিটির ২০টি দেশে ২৭টি কারখানা আছে এবং মোট ৭০টি দেশে ৫ হাজার শো রুম বা দোকান আছে। যা প্রতিষ্ঠার পর থেকে বাটা কোম্পানি ১৪ বিলিয়নেরও অধিক জুতা বিক্রি করেছে। বিশ্ব বিখ্যাত এই কোম্পানির বর্তমানে সিএও হচ্ছেন ভারতের সন্দীপ কাটারিয়া।
বাংলাদেশে বাটার ঘাটি গড়া ও ওডারল্যান্ড এর বীর প্রতীক খেতাব
বাংলাদেশে বাটা আসে ১৯৬০ সালে। তখন বাংলার মানুষ সবেমাত্র ভাষার অধিকার আদায় করেছে। পশ্চিমের শাসকদের নিত্য বঞ্চনা, বৈষম্য পূর্ব ভূখণ্ডের মানুষের প্রতি। পাকিস্তানিরা বাংলা ভাষীদের গুরুত্বের সঙ্গে না দেখলেও বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান বাটা এ ভূখণ্ডের সম্ভাবনা দেখতে পায়। ১৯৬২ সালে তারা একটি কারখানা তৈরি করে পূর্ব পাকিস্তানে। সেই কারখানাটাই হয়ে যায় বাংলাদেশের ইতিহাসের একটি অংশ। মুক্তিযুদ্ধের হল্যান্ডে জন্ম নেওয়া অস্ট্রেলীয় নাগরিক ওডারল্যান্ড বাংলাদেশে এসেছিলেন বাটার নির্বাহী পরিচালক হিসেবে ১৯৭০ সালে। যিনি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের যোদ্ধা। পশ্চিম পাকিস্তানের নিপীড়ন চোখ এড়ায় না এই দক্ষ যোদ্ধার। একাত্তরের ২৫ মার্চ রাতে যখন শুরু হয় পাকিস্তানি সৈন্যদের ধ্বংসযজ্ঞ, ওডারল্যান্ড তাঁর পক্ষ নির্ধারণ করে ফেলেন। তাঁর ভাষায়, একাত্তরের মার্চে যখন পাকিস্তানি সৈন্য আর ট্যাংক ঢাকার রাস্তায় নেমে এল, আমি যেন আমার যৌবনের ইউরোপে ফেরত গেলাম। বাটার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা হিসেবে ওডারল্যান্ডের যাতায়াত ছিল সর্বত্র। সেই সুযোগ নিয়ে মুক্তিযুদ্ধে ওডারল্যান্ড মুক্তিযোদ্ধাদের খাদ্য, তথ্য, অস্ত্র, ওষুধ সরবরাহ করেছেন। মুক্তিযোদ্ধাদের রণ কৌশল শিখিয়েছেন। তখন আমাদের বাটার টঙ্গীর কারখানাটা ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের গোপন ক্যাম্প। তিনি কর্মীদের যুদ্ধে যেতে উদ্বুদ্ধ করতেন। শুধু তা–ই নয়, ওডারল্যান্ড নিজেও জীবন বিপন্ন করে অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করেছেন। তাঁর নেতৃত্বে টঙ্গী-ভৈরব রেললাইনের ব্রিজ, কালভার্ট ধ্বংস করে যোগাযোগব্যবস্থা বিপর্যস্ত করেন মুক্তিযোদ্ধারা। তাঁর পরিকল্পনায় ও পরিচালনায় ঢাকা ও এর পার্শ্ববর্তী এলাকাগুলোতে বহু অপারেশন সংঘটিত হয়। এভাবেই ওডারল্যান্ডের হাত ধরে বাটা মিশে যায় বাংলাদেশের অস্তিত্বের সঙ্গে। বাংলাদেশ স্বাধীন হয়। বিদেশি এই বন্ধুর প্রতি কৃতজ্ঞতাস্বরূপ বাংলাদশ সরকার ওডারল্যান্ডকে ভূষিত করে বীর প্রতীক খেতাবে। ওডারল্যান্ডই একমাত্র বিদেশি, যিনি এই রাষ্ট্রীয় খেতাবে ভূষিত হয়েছেন।
বাংলাদেশে বাটার বর্তমান অবস্থা
কোম্পানির ওয়বসাইটের তথ্য অনুযায়ী, বাটা সু কোম্পানি বাংলাদেশে ১৯৬২ সাল কারখানা স্থাপন করে। এখন টঙ্গী ও ধামরাইয়ে দুটি কারখানা আছে। দুটি কারখানায় প্রতিদিন ১ লাখ ৬০ হাজার জোড়া জুতা তৈরির সক্ষমতা আছে। বাটা সু কোম্পানি প্রতিবছর বাংলাদেশে ৩ কোটি জোড়া জুতা বিক্রি করে। এছাড়াও এদের নিজস্ব ট্যানারি শিল্প রয়েছে। এই চামড়া দিয়েই তৈরি হয় বাটার জুতা, ব্যাগসহ নানা পণ্য। বাটা যে শুধু জুতার কোম্পানি, তাই ই নয়, বিভিন্ন দেশের সামাজিক কর্মকাণ্ডের বিভিন্ন কর্মসূচী গ্রহণ করে। এদেশেও খেলাধুলাকে উৎসাহিত করতে এটি বিভিন্ন সময়ে অনুষ্ঠিত খেলায় স্পন্সরশীপ দিয়ে থাকে। এই কোম্পানি দেশের বিকলাঙ্গ মানুষকে আর্থিক সহায়তা, দারিদ্র বিমোচন কর্মসূচীতে অংশগ্রহন, মেধাবী এবং বৃত্তিপ্রাপ্ত শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন ধরণের সহায়তা প্রদান করে। সেই সঙ্গে জাতীয় দূর্যোগে দরিদ্র এবং অবহেলিত মানুষকে সহায়তা প্রদান করে থাকে। এসবই তাদের কার্যালয়ের একটি ফান্ড থেকে দেয়া হয়। এসব সমাজ সেবামূলক কর্মকাণ্ড সুইজারল্যান্ড ভিত্তিক অর্গানাইজেশন এবং বাটা ফাউন্ডেশেন কর্তৃক পরিচালিত। এই কোম্পানি শিশুদের নিয়েও কাজ করে। বিশেষ করে তাদের ভরন-পোষণ, আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে এবং ভবিষ্যত সুনিশ্চিত করতে বিভিন্ন কর্মসূচী গ্রহণ করে থাকে। দরিদ্র এবং মেধাবী শিক্ষার্থীদের বাটা বিভিন্ন আর্থিক সহযোগীতা ছাড়া এর পণ্য বিনামূল্যে প্রদান করে থাকে। এটি পথশিশুদের পূনর্বাসন এবং তাদের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে ব্যপক কর্মসূচী গ্রহণ করে থাকে। ভালো ডিজাইন করা জুতা ছাড়া ফ্যাশন কখনই সম্পূর্ণ হবে না। এই বিপণন অন্তর্দৃষ্টি বাটাকে পুরুষ, মহিলা এবং শিশুদের জন্য বেশ কয়েকটি ডিজাইনারের সংগ্রহ প্রবর্তন করতে প্ররোচিত করেছে। বাটা কমফিট, মেরি ক্লেয়ার, হুশ পপি, স্কল, নাইকি, স্কেচারস, পাওয়ার, নর্থ স্টার, বাবলগামার্স, বেন 10, সান্দাক, ওয়েইনব্রেনার এবং বি ফার্স্টের মতো আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ব্র্যান্ডগুলি কয়েকটি নাম যা ব্র্যান্ডেড জুতা বিপণনের প্রতি উল্লেখযোগ্য পরিবর্তনের সাক্ষ্য দেয় বাংলাদেশে।
বাটার গত ৫ অর্থ বছরের আয়
কোম্পানিটি ২০১৬ সালে মুনাফা করে ১০৪ কোটি টাকা, ২০১৭ সালে মুনাফা করে ১১৫ কোটি টাকা, ২০১৮ সালে মুনাফা করে ৯৯ কোটি ৫০ লাখ টাকা এবং ২০১৯ সালে মুনাফা করে ৪৯ কোটি ৪০ লাখ টাকা আয় করেন।
বিক্রিতে ধস ও লোকসানে বাটা
করোনা মহামারীর ধাক্কা এখনও কাটিয়ে উঠতে পারেনি দেশের শীর্ষস্থানীয় জুতা প্রস্তুতকারক বাটা সুজ। যে কারণে বাংলাদেশে ব্যবসার ইতিহাসে সর্বোচ্চ লোকসানে পড়েছে কোম্পানিটি। দেশে গত বছর করোনাভাইরাস সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়লে বহুজাতিক কোম্পানিটি বড় ক্ষতির মুখে পড়ে, যা থেকে চলতি বছরেও বের হতে পারেনি তারা।বিক্রিতে ধস নামায় টানা লাভের মধ্যে থাকা কোম্পানিটি ২০২০ হিসাব বছর শেষে মোট লোকসান করেছে ১৩২ কোটি ৬১ লাখ টাকা। স্বাধীনতার আগে থেকে বাংলাদেশে আলাদা কোম্পানি খুলে ব্যবসা পরিচালনাকারী কোম্পানিটি সব সময় লাভেই মধ্যেই ছিল। কোম্পানিটি ২০১৯ সালের তুলনায় ২০২০ সালে বাটা শু কোম্পানি ৪১ শতাংশ আয় কম করেছে। আগের বছরের তুলনায় এতটা খারাপ বাটা শু বাংলাদেশে আর কোনো দিন করেনি। ফলে শ্রমিক ছাটাই ও ঈদ উল ফিতরের পর অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষনা করা হয়।
দেশের টাকা থাকছে দেশেই
বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান হলেও বাটার অধিকাংশ পণ্য তৈরি হয় বাংলাদেশে। এখানে কাজ করেন বাংলাদেশের মানুষ। এভাবে দেশের অর্থের বড় অংশ দেশেই থেকে যায়। মালিক মেহেদি কবির বলেন, ‘বাটায় আমরা মানে বাংলাদেশিরাই বেশি কাজ করে। বাংলাদেশে অনেক দিন কাজ করার ফলে বাটা বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান হলেও বাটা কিন্তু বাংলাদেশের অস্তিত্বের সঙ্গে মিশে গেছে। আমি গর্বের সঙ্গে বলছি, চার বছর ধরে লেদার এবং ফুটওয়্যার ইন্ডাস্ট্রিজে সর্বোচ্চ করদাতা বলে জানান বাটা বাংলাদেশের মানবসম্পদ বিভাগের জেনারেল ম্যানেজার মালিক মেহেদি কবির।