কানিজ-আল-হাক্ব। নামের চেয়ে “চাটগাঁইয়া শুঁটকি আপা” হিসেবে বেশি পরিচিতি তার । পড়াশোনা চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিসংখ্যান বিভাগের সম্মান শেষ বর্ষে। চট্টগ্রামের মেয়ে। ছোট থেকেই শুঁটকি খাওয়ার বেশ তোড়জোড় দেখে আসছেন। তবে শুঁটকি নিয়ে কটাক্ষ কিংবা কানাঘুষায় তার ভাবনায় নতুন চিন্তার উদ্রেক হয়। “ওরা শুঁটকি খায়— গন্ধ! ” এসব বাক্য যেনো প্রতিধ্বনিত হতো চারপাশে।
কেবল একটা খাবারের কারণে কাউকে কেন হেয় করা হবে? এমনটা মেনে নিতে নারাজ তিনি। এই সমস্যাকে গোড়া থেকে নির্মূল না করলেই নয়। অনুসন্ধানের পর জানলেন এই বিকট গন্ধটা তৈরী হয় শুঁটকিগুলো সঠিক উপায়ে তৈরী এবং সংরক্ষণ করা হয় না বলে। এছাড়াও আছে যথেচ্ছ রাসায়নিকের ব্যবহার। উন্নত প্রযুক্তি এবং পদ্ধতি ব্যবহার করে “অর্গানিক শুঁটকি” উৎপাদন করলে এই সমস্যা থেকে উত্তরণ সম্ভব। সেখান থেকেই “মিঃ শুঁটকি” র পথচলা।
কিভাবে প্রস্তুত হয় “মিঃ শুঁটকি”? কানিজ জানালেন, আমার প্রোডাক্ট ‘অর্গানিক শুঁটকি’ অনেকের কাছে নতুন ঠেকলেও এটা নিয়ে দেশীয়ভাবে প্রথম কাজ শুরু করেছিলেন আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়েরই রসায়নবিদ্যা বিভাগের মুকুল ভাই । প্রথমেই বাছাইকৃত সামুদ্রিক তাজা মাছ সংগ্রহ করা হয়। এরপর মাছগুলোকে সাইজ অনুযায়ী এমনভাবে কাটা হয়, যেন প্রতিটা অংশ খুব ভালোভাবে শুকাতে পারে। সমানভাবে সূর্যালোক প্রবেশ করতে পারে এবং খুব ভালোভাবে ময়লা পরিষ্কার করা যায়। এরপর উন্নতমানের ড্রায়ারে গ্রীণহাউস প্রক্রিয়ায় শুকিয়ে এই অর্গানিক শুঁটকি তৈরী করা হয় কোনরকম হাতের ছোঁয়া ছাড়াই। বেশি বিক্রিত প্রোডাক্টের মধ্যে আছে লইট্টা, ছুরি, নানা প্রজাতির চিংড়ি, ইলিশ, চ্যাপা, বাঁশপাতা , সুন্দরী, রূপচাঁদা, মলা, লাক্ষা, সুরমা ইত্যাদি।
উদ্যোক্তা হওয়ার কারণ জানতে চাইলে কানিজ বলেন, প্রথমেই বলতে হয় বেকারত্বের কথা । একেই আমাদের দেশে শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা দিনদিন বেড়েই চলেছে, অন্যদিকে করোনার হানা সারাবিশ্বের অর্থনীতি ও কর্মসংস্থান খাতকে এলোমেলো করে দিয়েছে। তাই বসে না থেকে আমি উদ্যোক্তা হওয়ার প্রচেষ্টাকেই শ্রেয় মনে করেছি এবং শুরু করেছি শূন্য থেকে। আমার পুঁজি বলতে ছিলো ৫ হাজার টাকা,তাও আরেকজন থেকে ধার করা। পরিবার প্রথমদিকে আমাকে সাপোর্ট করেননি। তবে এখন সবাই সোৎসাহে আমাকে এগিয়ে যাওয়ার অনুপ্রেরণা দিয়ে যাচ্ছেন।
এছাড়া খাদ্যদ্রব্যে ভেজাল , বিভিন্ন মারাত্মক কেমিক্যালের সহজলভ্যতা এবং কিছু ব্যবসায়ীর অসততায় জনজীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। বেড়েছে ক্যান্সার , হাই প্রেশার , কিডনি ও হার্ট ডিজিজের মতো মরণব্যাধিতে আক্রান্ত হওয়ার হার । কর্তৃপক্ষের সজাগ দৃষ্টি এবং যথাযথ আইনের প্রয়োগের পাশাপাশি সঠিক উপায়ে অর্গানিক শুঁটকির উৎপাদন এই পরিস্থিতি থেকে মুক্তি দিতে পারে পুরো জাতিকে। আবার আমার এখানে যারা কাজ করেন, তাদের বেশিরভাগই নারী। সর্বোচ্চ স্বাস্থ্য – সতর্কতা মেনেই তারা স্বাচ্ছন্দ্যে কাজ করেন । দেশের বাইরেও এই অর্গানিক শুঁটকির কদর প্রচুর। কেননা , সারাবিশ্বে বঙ্গোপসাগরের মাছই সবচাইতে সুস্বাদু আর পুষ্টিতেও সেরা হয়। এই খাতটি সেদিক থেকে যথেষ্ট সম্ভাবনাময় ।
“অর্গানিক শুঁটকি” সম্পর্কে মানুষের ধারণা না খুব একটা নেই বলা চলে। যে কারণে প্রথমদিকে সাড়া কম পেলেও তার ব্যাপক প্রচারণা সেই ঘাটতি দ্রুত কাটিয়ে উঠেছেন। কানিজ বলেন, আমি বিভিন্ন সোশাল মিডিয়ায় যুক্ত রয়েছি,সেখানকার প্রচারণা বেশ কাজে এসেছে। বর্তমানে আমার একটা পরিচিতি আছে। অনেকেই “মিঃ শুঁটকি” কে একনামে চেনেন। অল্প সময়েবএই অর্জনই বা কম কিসে। মাসে ২৫-৩০ টার মতো অর্ডার থাকছে। দেশের বাইরে থেকেও অনেকে অর্ডার করছেন। ভাবতে ভালো লাগে আমাদের দেশীয় একটা ভোগ্যপণ্য বিদেশের মাটিতেও সমাদৃত হচ্ছে।
আগামী দিনে নিজের কাজ এবং প্রতিষ্ঠান নিয়ে পরিকল্পনার কথা জানালেন কানিজ, মিঃ শুঁটকি নিয়ে লক্ষ্য অনেকদূর। স্বল্প পরিসরে কাজ শুরু করলেও আর কয়েক মাসের মধ্যে বৃহৎ পরিসরে কাজ শুরু করবো। এতে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের পাশাপাশি অনেক কর্মসংস্থানও তৈরী হবে। আমি স্বপ্ন দেখি ভেজালমুক্ত অর্গানিক শুঁটকির। সেই সঙ্গে সৎ নিষ্ঠাবান ব্যবসায়ী তৈরী হবে। শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা কমবে। সবাই নিজ নিজ জায়গা থেকে কিছু করার কথা চিন্তা করবে। যথাযথ আইনের প্রয়োগ এবং বিশেষ তদারকির আওতায় আসবে “অর্গানিক শুঁটকি” উৎপাদনের এই অপার সম্ভাবনাময় খাতটি ।