সফলতার পিছনে প্রয়োজন একটি স্বপ্ন,যা একজন ব্যক্তিকে বাস্তবে রূপ দিতে সাহায্য করবে।প্রতিটা সফল ব্যক্তি তার জীবনের প্রথম সময়ে একটি স্বপ্ন নিয়ে বাঁচে যেন তা এক সময় পূরণ করতে পারে।একজন উদ্যোক্তা তার জীবনে বিভিন্ন ঝুঁকি নেয়।কখনও তা সঠিক হয় আবার কখনও তা ভুল তবে পিছিয়ে পড়ে না।নতুন উদ্যমে আবার নিজেকে তৈরি করে নিয়ে ভবিষৎ এর জন্য প্রস্তুত হয়।মহাত্মা গান্ধী বলেছিলেন , ‘পৃথিবীতে তুমি যে পরিবর্তন দেখতে চাও, তা নিজ থেকেই শুরু করো।’একজন উদ্যোক্তা পৃথিবীতে পরিবর্তন আনতে কত পদক্ষেপ,কত নতুন চিন্তা ভাবনা বা ধারা তৈরি করে।একজন উদ্যোক্তা নিজে শুরু করে পরিবর্তন এবং পরিবর্তনের ডাক তারাই দেয়।পৃথিবী সময়ের সাথে বদলায় এবং এই বদলানোর পরিবর্তন আনে একজন উদ্যোক্তা। আজ আমাদের উদ্যোক্তার সফলতার গল্প সিরিজে থাকছে ঠিক তেমন একজন অসাধারন উদ্যোক্তা প্রিয়স্বপ্ন গ্রুপের চেয়ারম্যান মুহাম্মদ ইলিয়াস কাঞ্চনের গল্প।
প্রশ্ন : শুরুতেই জানতে চাই আপনার বেড়ে ওঠা সম্পর্কে?
মুহাম্মদ ইলিয়াস কাঞ্চন : আমি বড় হয়েছি গ্রামের আলো বাতাসে।জন্ম মুন্সীগঞ্জের শ্রীনগরে যা বিক্রমপুর নামেই অধিক পরিচিত।পরিবারের বড় ছেলে।বাবা ছিলেন শিক্ষক তাই খুব শাসন এবং নিয়ম শৃংখলার মধ্যে বড় হয়েছি।সৎ এবং সুন্দরভাবে জীবন গড়ার ভিত বাবা-মায়ের কাছ থেকে পেয়েছি।
প্রশ্ন : উদ্যোক্তা হওয়ার জার্নিটা শুরু হলো যেভাবে?
মুহাম্মদ ইলিয়াস কাঞ্চন : ছোটবেলা থেকেই আমার মধ্যে বড় কিছু করার স্বপ্ন কাজ করতো।স্কুল বয়স থেকেই ছোট ছোট বিজনেস করার চেষ্টা করতাম।একটা বই মূলত উদ্যোক্তা হওয়ার ইচ্ছাটা আমার মধ্যে তীব্র করে তোলে।বইটির নাম ‘রিচ ড্যাড পুওর ড্যাড ‘এই বইয়ের একটা লাইন আমাকে খুব আলোড়িত করে ‘দরিদ্র এবং মধ্যবিত্তরা অর্থের জন্য কাজ করে আর ধনীরা অর্থকে নিজের জন্য কাজ করায়।’এই বইটি পড়ার পর পরই আমি উদ্যোক্তা হওয়ার জন্য মাঠে নেমে পড়ি।ছোট ছোট বিভিন্ন ব্যবসায়িক উদ্যোগ নিতে থাকি।এসব উদ্যোগের অনেকগুলোই ব্যর্থ হয়।সবশেষ ২০০৪ সালে কলেজ লাইফের বন্ধুদের নিয়ে গড়ে তুলি প্রিয়স্বপ্ন নামে একটি সমবায় উদ্যোগ, যেটি এখন প্রিয়স্বপ্ন গ্রুপ নামে পরিচিত।
প্রশ্ন : বর্তমানে আপনার কোম্পানি কি কি সার্ভিস দিচ্ছে?
মুহাম্মদ ইলিয়াস কাঞ্চন : আমার প্রতিষ্ঠান প্রিয়স্বপ্ন গ্রুপ এখন ৮ টি ভিন্ন কোম্পানী নিয়ে গঠিত। আবাসন,শিক্ষা,ই-কমার্স,প্রসাধনী ও নিরাপদ খাদ্যপণ্য উৎপাদন ও বাজারজাত করণ,রপ্তানী এরকম নানামুখী প্রকল্প নিয়ে কাজ করছে।প্রায় দুই শতাধিক লোকের কর্মসংস্থান হয়েছে এই প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে।তাছাড়া বেকার জনগোষ্ঠীর কর্মসংস্থানের লক্ষে কর্মঠ নামে একটি প্লাটফর্ম গড়ে তুলেছি যার মাধ্যমে ইতোমধ্যে কয়েক হাজার তরুণ-তরুণীকে কাজের সুযোগ করে দিচ্ছি।বিকাশ,সিটি ব্যাংক,ইস্টার্ন ব্যাংকের মতো প্রতিষ্ঠান আমাদের কর্মঠ এর সার্ভিস নিচ্ছে।
প্রশ্ন : আমাদের দেশে ই-কমার্স ব্যবসার সম্ভাবনা নিয়ে কি বলবেন?
মুহাম্মদ ইলিয়াস কাঞ্চন : প্রযুক্তির অগ্রযাত্রার সাথে দেশের মানুষও অনেক বেশি গতিশীল যা আমরা অনলাইন কেনা-কাটায় সকলের মনোনিবেশ দেখে বুঝতে পারি। বাজার ব্যবস্থা সাধারনত গড়ে ওঠে লোক সমাগমকে কেন্দ্র করে।আগের দিনে বেশি লোক যেখানে সমাগম হতো সেখানেই গঞ্জের হাট বা বাজার গড়ে উঠতো।সে হিসেবে চিন্তা করলে মানুষ এখন সবচেয়ে বেশি সময় কাটায় বা একত্রিত হয় ইন্টারনেটে।ওয়ার্ল্ড ইকোনমি ফোরাম এর এক অনুচ্ছেদে দেখা যায় ইন্টারনেট দুনিয়ায় মাত্র ১ মিনিটে মানুষ গুগলে সার্চ করছে ৩.৭ মিলিয়ন,টেক্সট ম্যাসেজ সেন্ড করছে ১৮ মিলিয়ন,ইউটিউব ভিডিও দেখছে ৪.৩ মিলিয়ন,ইমেইল পাঠাচ্ছে ১৮৭ মিলিয়ন,ওয়াটস এ্যপে ৩৮ মিলিয়ন,ফেসবুক লগিন করছে ৯ লক্ষ ৩৭ হাজার মানুষ এভাবে অন্যান্য সোশ্যাল সাইটেই সময় দিচ্ছে অসংখ্য মানুষ।
মিলেনিয়াম বা ওয়াই কিংবা জেড প্রজন্ম ইন্টারনেট ছাড়াই কিছুই বোঝে না,এই প্রজন্ম বাজারে গিয়ে কেনাকাটা করবে সে কথা কল্পনা করা বোকামী।সেই দিন আর বেশি দূরে নয় যখন দেশের সকল মানুষ ঘরে বসেই তাঁর নিত্য দিনের প্রয়োজনীয় সকল কেনাকাটা করবে।এই সমীকরণগুলো বুঝেই ই-কমার্স বিজনেসে আমার পদার্পণ।তারই প্রতিফলন হিসেবে ২০১৭ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে “কেনাকাটায় প্রাপ্তির উচ্ছাস’’ এই শ্লোগান নিয়ে যাত্রা শুরু করে ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান “প্রিয়বাজার”।
প্রশ্ন : বাংলাদেশে অর্গানিক পণ্যর ব্যবসা, লক্ষ্য ও করণীয় কি?
মুহাম্মদ ইলিয়াস কাঞ্চন : দিন দিন মানুষ অনেক সচেতন হচ্ছে।তাই অর্গানিক ও প্রাকৃতিক পন্যের বিশাল একটা বাজার গড়ে উঠেছে পুরো বিশ্বব্যাপী।আমাদের দেশও যাতে এ ব্যাপারে পিছিয়ে না থাকে সে লক্ষ্যে আমরা ন্যাচারালস নামে একটা ব্র্যান্ড লঞ্চ করেছি ।আমরা প্রাকৃতিক প্রসাধনী ও নিরাপদ খাদ্য সামগ্রী তৈরি করছি।এই ব্র্যান্ডের মূল লক্ষ্য দেশের বাইরে আমাদের দেশীয় পন্যের বাজার সৃষ্টি করা।
প্রশ্ন : আমরা জেনেছি যে, উদ্যোক্তা তৈরিতে আপনার প্রতিষ্ঠান কাঞ্চন ইন্সটিটিউট কাজ করছে, এটি সম্পর্কে বলুন।
মুহাম্মদ ইলিয়াস কাঞ্চন : আপনি অবগত আছেন “নো ফুল স্টপ অন ড্রিমিং” স্লোগান নিয়ে দেশ ব্যাপী অনলাইন ও অফলাইন প্রশিক্ষণ এবং সহায়তা কার্যক্রম নিয়ে কোচ কাঞ্চন ইন্সটিটিউট এক জামজমক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে গত বছর আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু করে ।এটা মূলত একটি প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠান এখানে সব ধরণের কর্পোরেট প্রশিক্ষণ দেয়া হয় যার মধ্য অন্যতম হলো লিডারশীপ,কমিউনিকেশন স্কিল,প্রফেশনালিজম,ডিজিটাল মার্কেটং,সেলিং ফ্যান্টাসি ইত্যাদি।সম্ভাবনাময় তরুণ প্রজন্মকে যোগ্য করে তুলতে আমাদের রয়েছে বিভিন্ন ধরনের ওয়ার্কশপ ও ক্যারিয়ার গ্রুমিং সেশন।এছাড়া সুখি ও সুন্দর পারিবারিক জীবনের জন্য আমাদের কিছু বিশেষ সেশন রয়েছে যেমন- হাউ টু বি এ বেটার হাফ,এংগার ও স্ট্রেস ম্যানেজমেন্ট,ফান্ডিং হ্যাপিনেস ইত্যাদি।
কোচ কাঞ্চন ইন্সটিটিউট এর মিশন হচ্ছে বর্তমান প্রজন্মের যুব সমাজকে তাদের পরিচিত গণ্ডী থেকে বের করে এমন একটি শক্তিশালী, দক্ষ এবং স্বশিক্ষিত ভবিষ্যৎ প্রজন্ম গড়ে তুলতে সহায়তা করা যেন সে কারো উপর নির্ভরশীল না থাকে।এটিকে বিশ্বের অন্যতম সেরা নলেজ শেয়ারিং প্লাটফর্ম হিসেবে গড়ে তুলতে চাই যেখানে সারা পৃথিবীর সব সফল মানুষেরা নিজেদের অনুপ্রেরণার গল্প শেয়ার করবে।
প্রশ্ন : ছোটবেলা থেকে আপনার স্বপ্ন কি ছিল, সাফল্যের পিছনে মূলমন্ত্র কি?
মুহাম্মদ ইলিয়াস কাঞ্চন : একটাই স্বপ্ন মানুষের স্বপ্ন পূরণে পাশে থাকা।অন্যের জন্য নিজের সবটুকু বিলিয়ে দিতে চাই।এর মাঝেই জীবনের স্বার্থকতা খুঁজে পাই। সাফল্যের মূলমন্ত্র একটাই হাল ছেড়ে না দিয়ে লেগে থাকা,এতে জয় আসবেই।আমার কোন প্লান বি নেই।যেটা নিয়ে নেমেছি সেটার শেষ দেখার চেষ্টাটাই আমাকে এতদূর এনেছে।
প্রশ্ন : অন্যদের তুলনায় আপনি ব্যতিক্রম কোন ক্ষেত্রে?
মুহাম্মদ ইলিয়াস কাঞ্চন : আসলে পৃথিবীর প্রতিটা মানুষ ইউনিক কেউ কারো মতো নয়।আমি প্রচন্ড বিশ্বাসী একজন মানুষ।An ordinary man with extra ordinary believe nothing else।
প্রশ্ন : আপনি তো ট্রেনিং প্রফেশন এর সাথে সক্রিয়ভাবে জড়িত। বাংলাদেশে ট্রেনিং প্রফেশন সম্ভাবনা সম্পর্কে বলুন।
মুহাম্মদ ইলিয়াস কাঞ্চন: এটা অনেক বড় এবং সম্ভাবনাময় একটা সেক্টর।দেশের পুরো চেহারা চেঞ্জ করে দিতে পারে ট্রেনিং ইন্ডাস্ট্রি।কিন্তু আমরা অনেক পিছিয়ে আছি এখনো।ট্রেনিং এর নামে শুধু বড় বড় ইভেন্ট হচ্ছে আক্ষরিক অর্থে কার্যকর উদ্যোগ খুবি কম।কেন্দ্রীয় শক্ত কোন বডি না থাকায় যত্রতত্র মানহীন অনেক আয়োজন হচ্ছে। সম্মিলিত উদ্যোগে এটাকে একটা ইন্ডাস্ট্রিতে পরিনত করতে পারলে সবাই উপকৃত হবে।
প্রশ্ন : সবশেষে উদ্যোক্তা হতে চায় এমন তরুণদের জন্য আপনার কী পরামর্শ থাকবে!
মুহাম্মদ ইলিয়াস কাঞ্চন : তরুনদের মাঝে বিজনেস করার প্রচন্ড ইচ্ছা বা আগ্রহ দেখা যায়,কিন্তু কিভাবে শুরু করবো,কি পণ্য নিয়ে কাজ করবো,কাস্টমার কোথায় পাবো,রেভিনিউ মডেল কি হবে,মার্কেটিং কোথায় করবো এগুলো নিয়ে থাকে নানা কনফিউশন। অনেকে আবার ভুল ভাবে বিজনেস করে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বেশিরভাগ উদ্যোক্তা শুধু সঠিক দিক নির্দেশনার অভাবে স্বপ্ন এবং বাস্তবতার মাঝে এই দূরত্বটুকু ঘোচাতে ব্যর্থ হয়। আসলে ব্যবসা কোন মোটিভেশনের জিনিস না,অনেক জেনে বুঝে হিসেব কষে ব্যবসায় নামতে হবে।