ইভ্যালী! তিনমাস পরপর হেডলাইন হওয়া এর স্বভাব। খুব আশ্চর্যের কিছু নেই, নেগেটিভ ব্যাপারেই সামনে আসে এরা। আর অনেক ক্ষেত্রে এই নেগেটিভ ব্যাপারটা ‘ক্রিয়েটেড ‘ বলেই গণ্য হয়। এত জরিপ, এত ডাটা, এত রিসার্চ দিয়ে প্রমাণের চেষ্টা করা হয়, ‘ এরা হয়তো পাততাড়ি গুটিয়ে পালাবে! এমনও তো হতে পারতো, মিডিয়া যাচাই করে দেখলো, ‘আমরা একটু দেখি এদের গ্রাহক সন্তুষ্টি কেমন? কমপক্ষে তিনটা জিনিস অর্ডার করেছেন এমন মানুষেরা কি ফিডব্যাক দিচ্ছেন একটু জেনে নেয়া তো যেতে পারে।
কিন্তু প্রায়সময়ই ট্রেন দেরীতে আসার নিউজটাই প্রাধান্য পায়। আমরা বলতে চাই, পজিটিভিটিও আসুক, সংখ্যায় একটু কম হলেও আসুক। আরে ভাই, বয়েস কতো ইভ্যালীর? আবার এমন প্রশ্নও আসতে পারে, ইভ্যালীর কাস্টমার সন্তুষ্টির জরিপ পত্রিকা কেন করবে? এরচেয়ে বরং আর্থিক স্টেটমেন্ট তুলে দেয়াটা সহজ না? জরিপে এত ডাটা নিয়ে কেমনে কি করবো। তারচেয়ে হাতের কাছে যা আছে তাই তুলে দিই কাগজে !
কথা হয়েছে, হবে, হতে থাকবে। এত ডামাডোলে প্রশ্ন হলো, ইভ্যালী পালাবে এটা ইভ্যালীর চিন্তার বিষয় না হলেও একটা অংশের চিন্তার বিষয়। ইভ্যালী নিয়ে গত ক’দিনে বেশ মুখরোচক খবরই সামনে এসেছে। পক্ষে বিপক্ষে বাদানুবাদ চলছে। অনেকেই বুঝে উঠতে পারছেন না কি করা উচিত। অনেকে কড়া সমালোচনা যেমন করছেন, যুক্তিযুক্ত লেখনীর মাধ্যমে অনেকেই তুলে ধরতে চাইছেন প্রকৃত অবস্থা।
ই-কমার্স বার্তা ই-কমার্স ফোকাসড একটা অনলাইন ম্যাগাজিন বলেই তাদের কাছে মনে হয়েছে দেশীয় ই-কমার্সের সম্ভাবনা নিয়ে কথা বলা র্যাংকস এফসি প্রপার্টিজের সিইও তানভীর শাহরিয়ার রিমনের ভাবনাগুলো তুলে ধরা দরকার। তাই নিজের ফেসবুকে লেখা তানভীর শাহরিয়ার রিমনের সেই স্ট্যাটাস পাঠকের উদ্দেশে তুলে ধরা হলো-
আমি চাই বাংলাদেশে ই-কমার্স বিপ্লব ঘটুক। এদেশে আমাজন, আলীবাবা, ফ্লিপকাট, ইবে, জিংডং, রাকুটেন এর মতো প্রতিষ্ঠান তৈরী হোক। সবাই হয়ত একটু হাসবেন। তবে তার আগে একটু তথ্য দিই, বছরে ৩০০ বিলিয়ন ডলারের বেশি রেভিনিউ আমাজনের, যখন তার নিকটতম রাইভালের রেভিনিউ ৮২ বিলিয়ন ডলার। বুঝতেই পারছেন আমাজন কত বড় জায়ান্ট প্রতিষ্ঠান। আমাদের পাশের দেশে ফ্লিপকাটের রেভিনিউ বছরে ৬ বিলিয়ন ডলারের কাছাকাছি।
কেবল রেভিনিউ দিয়ে কী একটা ব্যবসা সাসটেইন করে ? করেনা । মুনাফা করতে হয় । লোক মুখে শুনেছি, ইভ্যালী ৪ টাকায় কিনে ১ টাকায় প্রডাক্ট বিক্রী করে। তার মানে মুনাফা তো দূর, তারা তো ব্রেকইভেনেও নাই। তাদের আরওআই (রিটার্ন অন ইনভেস্টমেন্ট) প্ল্যান কি সেটাও আমি জানিনা।
ধরেন, ইভ্যালীর মাসিক রাজস্ব ১০০০ কোটি টাকা। তাহলে বছরে আনুমানিক দেড় বিলিয়ন ডলার। কিন্তু সেজন্য তার খরচ বছরে প্রায় ৬ বিলিয়ন ডলার। তাহলে ৪.৫ বিলিয়ন ডলার তার সরাসরি লস। অংকটা হয়ত এরকম না। জাস্ট একটা হাইপোথিসিস দিলাম আরকি! কিন্তু এই অংক থেকে আপনি কী সরলীকরণ করে ফেলবেন যে ইভ্যালী “ইউনিপেটু” কিংবা “জিজিএন নেটওয়ার্ক” এর মতো পালাবে? দাঁড়ান, দাঁড়ান। এখনি সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলার দরকার নাই। তার আগে ইকমার্স জায়ান্টদের শুরুর গল্প গুলো একটু রিভিউ করে নেন।
পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ই-কমার্স মার্কেট প্লেস আমাজন যখন ব্যবসা শুরু করে তাদের লাভের মুখ দেখতে লেগেছে ৯ বছর। ১৯৯৯ সালে অ্যামাজনের রেভিনিউ ছিল ১.৬ বিলিয়ন ডলার । অথচ বছর শেষে লস ছিল ৭১৯ মিলিয়ন ডলার ! পরের বছরও অবস্থার পরিবর্তন হয়নি । বরং লাভের মুখ দেখতে তাদের অপেক্ষা করতে হয়েছিল ২০০৩ সাল পর্যন্ত। ক্যাপিটাল মার্কেটে অ্যামাজন আসে ১৯৯৬ সালে, সেই হিসাবে লাভের মুখ দেখে ৭ বছর পর। আর প্রতিষ্ঠা যেহেতু ১৯৯৪ তে সেই হিসাবে লাভ গুনতে সময় লাগে ৯ বছর! অথচ ২০২০ এ ২১ বিলিয়ন ডলার নেট মুনাফা করে অ্যামাজন। কী বুঝলেন?
এই পরিসংখ্যান যদি যথেষ্ট না হয় তবে বাকী জায়ান্টদের মুনাফার মুখ দেখতে এভারেজে কত সময় লেগেছিল তা নিজেরা গুগল থেকে জেনে নিতে পারেন । একটা পরিসংখ্যান শেয়ার করি । ২০১৯ সালে বিশ্বে লোকজন অনলাইন সাইটে ৩.৪৬ ট্রিলিয়ন ডলার ব্যয় করে। ২০২১ এ এসে সেটা দাঁড়ায় ৪.৯ ট্রিলিয়ন ডলারে! ২০৪০ সাল নাগাদ পৃথিবীর ৯৫ শতাংশ মানুষ অনলাইনে কেনা কাটা করবে বলে মনে করা হচ্ছে । বর্তমানে ই কমার্স ব্যবসায় নতুন ট্রেন্ড চালু হয়েছে যেটাকে ভয়েস টেকনোলজি বলা হচ্ছে। “অ্যামাজন ইকো” কিংবা “গুগল হোম” সম্পর্কে যারা জানেন তারা বিষয়টা সহজেই ধরতে পারবেন।
কাজেই ইভ্যালীকে অপপ্রচার কিংবা কর্পোরেট রাজনীতিতে ফেলে দিয়ে মেরে না ফেলে একটু সাসটেইনেবল বিজনেস মডেল তৈরী করার মতো সময় দিন। দেশে ইকমার্স রেগুলেটরি বডিতে যারা আছেন তাদেরকে বুঝানোর দায়িত্ব অবশ্য ইভ্যালীর, যে তাদের মডেলটা কী। তারা কী করে তাদের গ্রাহকদের লগ্নি ফেরত দেবে, তারা কিভাবে টিকে থাকবে । বর্তমানে তারা যে ডেফিসিটে আছে সেটা কিভাবে তারা পুরণ করবে, তাদের আরওআই প্ল্যান কি, তাদেরকে কারা অর্থায়ন করবে, ইত্যাদি।
এখন কেউ যদি ৫০% দামে প্রডাক্ট কিনে আশা করেন পরের দিন তার দরজায় কড়া নাড়বে ইভ্যালী সেটা একটু বেশি আশা হয়ে গেলনা । আপনি যদি অর্ধেক দামে প্রডাক্ট কিনতে চান সেটা তো আপনার চয়েজ । আপনার চয়েজ আপনি ঠিক করবেন । আমারটা আমি।
আপনাদের একটা তথ্য দিই, পৃথিবীর তাবৎ সম্পদের ৫০ শতাংশ দখল করে আছে কেবল ১ শতাংশ মানুষ। এই সম্পদশালীরা চায়না আর কেউ সম্পদশালী হোক । সেটা আপনি বুঝতে পারবেন যখন জানবেন, সোশ্যাল মিডিয়া কিং ফেইসবুক কী করে আর কাউকে দাঁড়াতে দেয়নি। যখনই ইন্সট্রাকে থ্রেট মনে করেছে, কিনে নিয়েছে, যখন মনে হয়েছে হোয়াটসআপ কেনা দরকার কিনে ফেলেছে। এভাবে তারা বিগত ১০ বছরে প্রায় ৫০ টি কোম্পানি কিনেছে।
গুগল বিগত দশ বছরে প্রায় ২০০ টি কোম্পানি কিনেছে। অ্যামাজন প্রায় ১০০ টি কিনেছে। তার মানে কী? মনোপলি করা? পুজিবাদের খেলাটাই এইট। এখন কাল যদি অ্যামাজন এসে ইভ্যালী কিনতে চায় কিংবা যেভাবে ফ্লিপকাট এর ৭৭ শতাংশ কিনেছে ওয়ালমার্ট সেরকম আলীবাবা কিংবা জিংডং ইভ্যালী খেয়ে ফেলে, কি নিশ্চয়তা আপনি পাবেন যে বাংলাদেশ থেকে আরেকটি বড় ইকমার্স দাঁড়াবে?
উল্টা যদি এরকম হয় যে ইভ্যালী বিভিন্ন দেশে দেশে যাচ্ছে এবং একুইজিশন করছে তাহলে কেমন হবে? আমাদের দেশের প্রতিষ্ঠান গুলোকে নিয়মের মাঝে এনে বড় করার দায়িত্ব আমাদের নীতি নির্ধারকদেরই নিতে হবে।
ই-কমার্স বার্তা বিশ্বাস করে আগামীর দিন ই-কমার্সের। বড় হতে সময় লাগে, দাঁড়াতে সময় লাগে, করে দেখাতে সময় লাগে, প্রত্যয়েও সময় লাগে, তবে ভাঙতে সময় লাগে না। সময় দিন, করে দেখাবে ইভ্যালী।
– ই-কমার্স বার্তা টীম কতৃক পরিমার্জিত ও সংযোজিত
সঠিক কথা সময়ের প্রয়োজন।