
জেফ বেজোসের মহাকাশ কোম্পানি Blue অরিজিন বহুদিন ধরে তাদের প্রথম কক্ষপথ রকেট নিউ গ্লেন ছাড়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে। এটি তাদের একটি বড় লক্ষ্য অর্জনের উদ্দেশ্যে তৈরি করা প্রকল্প, যা সফল হলে মহাকাশ শিল্পে কোম্পানিটির অবস্থান আরও দৃঢ় হবে। তবে, এই অনেক দিন ধরে উৎক্ষেপণ কার্যক্রম সোমবার সকালে স্থগিত করতে বাধ্য হয় কোম্পানি। রকেটের একটি সাব-সিস্টেমে অনির্দিষ্ট সমস্যা দেখা দেওয়ায় তারা এই সিদ্ধান্ত নেয়।মহাকাশ অভিযানে এমন বিলম্ব খুবই সাধারণ বিষয়। যেকোনো ধরনের প্রযুক্তিগত ত্রুটি রকেট উৎক্ষেপণের ক্ষেত্রে মারাত্মক হতে পারে। তাই, নিউ গ্লেনের কাউন্টডাউনের মাঝামাঝি সময়ে সমস্যা দেখা দেওয়ায় কোম্পানি অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে লঞ্চ বাতিল করে। Blue অরিজিনের মতে, এই সমস্যা সমাধান করে পুনরায় উৎক্ষেপণ প্রস্তুত করতে কমপক্ষে ৪৮ ঘণ্টা সময় লাগবে। তবে, এটিই একমাত্র চ্যালেঞ্জ নয়। আটলান্টিক মহাসাগরে এই সপ্তাহে আবহাওয়ার অবস্থা আরও খারাপ হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে, যা নিউ গ্লেনের বুস্টার ড্রোন শিপে অবতরণ প্রক্রিয়ায় ঝুঁকি বাড়াতে পারে।নিউ গ্লেন রকেটটি Blue অরিজিনের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এতদিন কোম্পানিটি মূলত তাদের ছোট নিউ শেপার্ড রকেট ব্যবহার করে পর্যটক ও বিজ্ঞান পরীক্ষা সাব-অরবিটাল স্পেসে পাঠানোর কাজে ব্যস্ত ছিল। কিন্তু নিউ গ্লেন তাদের বৃহৎ পরিকল্পনার অংশ। এটি ভারী পে-লোড বহনের জন্য ডিজাইন করা হয়েছে, যা মহাকাশে স্যাটেলাইট, বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতি এবং অন্যান্য উপকরণ পাঠাতে সক্ষম। ইতিমধ্যে নাসা, স্পেস ফোর্স, এবং অ্যামাজনের প্রজেক্ট কুইপারের মতো সংস্থাগুলোর সঙ্গে Blue অরিজিনের চুক্তি হয়েছে।নিউ গ্লেনের উৎক্ষেপণ সফল হলে Blue অরিজিন এমন একটি ভারী লিফ্ট বাজারে প্রবেশ করবে, যা বর্তমানে স্পেসএক্সের মতো কোম্পানির দখলে।
স্পেসএক্সের ফ্যালকন ৯ এবং ফ্যালকন হেভি রকেট ইতোমধ্যেই মহাকাশ শিল্পে বিপ্লব ঘটিয়েছে। নিউ গ্লেন সেই প্রতিযোগিতায় Blue অরিজিনকে শক্তিশালী অবস্থানে নিয়ে আসতে পারে।গত ৯ জানুয়ারি নিউ গ্লেন রকেটটি ফ্লোরিডার কেপ ক্যানাভেরালের লঞ্চপ্যাডে নিয়ে আসা হয়। প্রায় ৩২০ ফুট উচ্চতার এই রকেটটি প্রথমে ১২ জানুয়ারি উৎক্ষেপণের জন্য নির্ধারিত ছিল। তবে, সফল বুস্টার অবতরণ নিশ্চিত করার লক্ষ্যে লঞ্চ একদিন পিছিয়ে ১৩ জানুয়ারিতে নেওয়া হয়। উৎক্ষেপণের সময় রকেটে প্রপেল্যান্ট লোড করা হলেও প্রযুক্তিগত সমস্যার কারণে সময় একাধিকবার পরিবর্তন করা হয়। শেষ পর্যন্ত, ভেন্ট লাইন বরফ জমে বন্ধ হয়ে যাওয়ার সমস্যার সমাধান করতে না পারায় লঞ্চ বাতিল করা হয়।Blue অরিজিনের মতে, নিউ গ্লেনের প্রথম উৎক্ষেপণের প্রধান লক্ষ্য হচ্ছে এটি সুরক্ষিতভাবে কক্ষপথে পৌঁছে দেওয়া। এর বাইরে যা কিছু অর্জন করা যাবে, তা বাড়তি সাফল্য হিসেবে বিবেচিত হবে। এই উৎক্ষেপণে নিউ গ্লেন একটি Blue রিং স্পেসক্রাফট ডেমনস্ট্রেটর বহন করবে, যা ভবিষ্যতে মহাকাশ অর্থনীতি গড়ে তোলার একটি গুরুত্বপূর্ণ ভিত্তি হয়ে উঠবে।এ ধরনের বিলম্ব Blue অরিজিনের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ হলেও এটি তাদের দীর্ঘমেয়াদী লক্ষ্যের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। রকেট উৎক্ষেপণের সাফল্য নির্ভর করে প্রস্তুতির নির্ভুলতার ওপর। তাই, কোম্পানি কোনো ঝুঁকি নিতে রাজি নয়। নিউ গ্লেনের উৎক্ষেপণ শুধু Blue অরিজিনের জন্য নয়, মহাকাশ শিল্পের জন্যও একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক হয়ে উঠতে পারে।নিউ গ্লেন রকেটটি শুধুমাত্র Blue অরিজিনের নয়, গোটা মহাকাশ শিল্পের জন্য একটি যুগান্তকারী প্রকল্প। এটি নির্মাণে ব্যবহার করা হয়েছে অত্যাধুনিক প্রযুক্তি, যা একে তুলনামূলকভাবে আরও শক্তিশালী এবং বহুমুখী করে তুলেছে। রকেটটি প্রায় ৪৫ টন ওজন বহন করতে পারে এবং এটি মহাকাশে বড় আকারের স্যাটেলাইট এবং গবেষণা সরঞ্জাম পাঠানোর জন্য ডিজাইন করা হয়েছে। এর প্রতিযোগী স্পেসএক্সের ফ্যালকন হেভি রকেটের মতো, নিউ গ্লেনও পুনঃব্যবহারযোগ্য। এর বুস্টার অংশ ড্রোন শিপে অবতরণ করানোর পরিকল্পনা করা হয়েছে, যা খরচ সাশ্রয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।Blue অরিজিন দীর্ঘদিন ধরে মহাকাশ ভ্রমণ এবং উপগ্রহ পাঠানোর জন্য একটি নির্ভরযোগ্য প্ল্যাটফর্ম তৈরি করতে কাজ করছে। নিউ গ্লেন সেই লক্ষ্য পূরণের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ।
এই রকেটের সাহায্যে কোম্পানিটি বাণিজ্যিক মহাকাশ সেবা বাজারে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করতে চায়। ইতিমধ্যে নাসা এবং স্পেস ফোর্সের সঙ্গে বেশ কিছু পে-লোড চুক্তি হয়েছে, যা কোম্পানিটির ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা আরও উজ্জ্বল করেছে।নিউ গ্লেন রকেটটি প্রথমে ২০২০ সালে উৎক্ষেপণের জন্য পরিকল্পনা করা হয়েছিল। তবে, বিভিন্ন প্রযুক্তিগত সমস্যা এবং পরীক্ষার কারণে তারিখ একাধিকবার পিছিয়ে যায়। এবারও একই ধরণের সমস্যার কারণে লঞ্চ বিলম্বিত হয়েছে। যদিও এটি কোম্পানির জন্য একটি চ্যালেঞ্জ, তবে তারা এই পরিস্থিতি থেকে শিক্ষা নিয়ে ভবিষ্যতের উৎক্ষেপণগুলো আরও নিখুঁত করতে পারবে।এছাড়াও, নিউ গ্লেনের সফল উৎক্ষেপণ ভবিষ্যতের বৃহৎ মহাকাশ প্রকল্পগুলোর জন্য দরজা খুলে দেবে। Blue অরিজিন ইতিমধ্যে চাঁদে অবতরণ মিশন এবং মহাকাশ স্টেশন নির্মাণের মতো প্রকল্প নিয়ে কাজ করছে। নিউ গ্লেন সেই প্রকল্পগুলোতে মূল ভূমিকা পালন করতে পারে।নিউ গ্লেন রকেটটি ৭ মিটার ব্যাসের একটি ফেয়ারিং নিয়ে তৈরি, যা এটি প্রচলিত রকেটগুলোর তুলনায় অনেক বড় পে-লোড বহন করতে সক্ষম করে। এর প্রথম পর্যায়ের ইঞ্জিন BE-4, যা লিকুইড অক্সিজেন এবং মিথেন প্রপেল্যান্ট ব্যবহার করে। এটি শুধু শক্তিশালীই নয়, পরিবেশবান্ধবও। রকেটের দ্বিতীয় পর্যায়ে BE-3U ইঞ্জিন ব্যবহার করা হয়েছে, যা আরও কার্যকরী পে-লোড পাঠানোর সুযোগ তৈরি করে।এটি শুধুমাত্র একটি রকেট নয়, বরং Blue অরিজিনের দীর্ঘমেয়াদী কৌশলের একটি প্রতীক। কোম্পানিটি ভবিষ্যতে এমন একটি মহাকাশ অর্থনীতি তৈরি করতে চায় যেখানে স্যাটেলাইট যোগাযোগ, বৈজ্ঞানিক গবেষণা এবং এমনকি মহাকাশে বসবাস সম্ভব হবে। নিউ গ্লেন সেই স্বপ্নের প্রথম ধাপ।এই প্রকল্পটি Blue অরিজিনের প্রতিদ্বন্দ্বী স্পেসএক্সের ফ্যালকন ৯ এবং ফ্যালকন হেভি রকেটের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ হতে পারে। স্পেসএক্সের মত বড় কোম্পানিগুলোর সঙ্গে প্রতিযোগিতা করতে হলে Blue অরিজিনকে প্রতিটি ধাপ অত্যন্ত যত্নসহকারে পরিকল্পনা করতে হবে।Blue অরিজিন বলেছে যে, নিউ গ্লেনের প্রথম উৎক্ষেপণের লক্ষ্য কেবলমাত্র কক্ষপথে পৌঁছানো। তবে এই চ্যালেঞ্জ পূরণ করা তাদের জন্য বড় অর্জন হবে। সফল উৎক্ষেপণের পর রকেটটি ভবিষ্যতে আরও উচ্চাভিলাষী প্রকল্পগুলোর জন্য ভিত্তি স্থাপন করবে।Blue অরিজিন এই মুহূর্তে রকেটের সমস্যাগুলো চিহ্নিত করে সমাধান করার জন্য কাজ করছে। এটি তাদের প্রযুক্তিগত সক্ষমতার একটি প্রমাণও বটে। উৎক্ষেপণের প্রতিটি দিক বিশদভাবে পরীক্ষা করা হচ্ছে যাতে ভবিষ্যতে এমন সমস্যার পুনরাবৃত্তি না ঘটে।নিউ গ্লেন শুধুমাত্র একটি রকেট নয়, এটি Blue অরিজিনের ভবিষ্যতের পরিকল্পনার একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিফলন। এই রকেটটির সফল উৎক্ষেপণ কেবল কোম্পানির জন্য নয়, মহাকাশ অভিযানের ইতিহাসেও একটি মাইলফলক হয়ে উঠবে।