পথ চলতে চলতে হোচট খেয়ে আমরা অনেকেই থেমে যাই, সামনে এগুতে ভয় পাই। অনেকেই জীবনের অনেকটা পথ পাড়ী দিয়ে এসে ভাবি এখন আর সময় কই নতুন কিছু করার। কিন্তু হোচটকে ভয় পেয়ে থেমে না গিয়ে সেখান থেকেই নতুন রাস্তা খুঁজে নিয়েই সামনে এগুতে হয় আর এভাবেই আসে সফলতা। আসলে নতুন কিছু করার জন্য বয়স বা সময় লাগে না। প্রকৃতপক্ষে যার যখন ঘুম ভাঙ্গে তার জন্য তখনই দিনের শুরু। আজকে কথা বলব এমন একজনকে নিয়ে যিনি বয়সকে হার মানিয়েছেন নিজের চেষ্টার কাছে। পৃথিবীজুড়ে বিখ্যাত হয়েছেন এমন বয়সে যে বয়সে আমরা নিজেকে নিয়ে নতুন কিছু ভাবতেই ভুলে যাই। কথা বলছি কর্নেল হারল্যান্ড ডেভিড স্যান্ডারস এর যিনি হলেন বিশ্ববিখ্যাত কেএফসির প্রতিষ্ঠাতা।
কর্নেল হারল্যান্ড তার প্রথম জীবনে একেবারেই সাধারন মানুষ ছিলেন। তিনি তার পড়ালেখা শেষ করতে পারেন নি। জীবন ধারনের তিনি অনেক প্রচেষ্টাই করেছেন। যেমন কখনো একজন খেতমজুর, কখনো ট্রেনের ফায়ারম্যান হয়ে, আবার গাড়ির টায়ার বিক্রেতা, ডিঙ্গি নৌকার ব্যাবসা, বীমা কোম্পানীরত সেলসম্যান, আইনজীবী, ফিলিং স্টেশনের কর্মচারী, অসফল রাজনীতিক এমনকি শখের ধাত্রীবিশারদ হিসেবেও তিনি সময় সময় কাজ করেছেন। এত চড়াই উৎরাই পার করে এসে শেষ জীবনে তিনি একজন রেস্তোরাঁ ব্যবসায়ী হিসেবে কাজ করেন।
কর্নেল হারল্যান্ড ১৮৯০ সালের ৯ সেপ্টেম্বার জন্মগ্রহন করেন। ইন্ডিয়ানার হেনরিভ্যালি থেকে কয়েক কিলোমিটার দূরের একটি বাড়িতে তার জন্ম হয়। তিনি উইলবার ডেভিড এবং মার্গারেট অ্যানের প্রথম সন্তান। কর্নেল হারল্যান্ড এর বাবার এক দুর্ঘটনায় পা ভেঙ্গে যায়। ১৮৯৫ সালে তিনি মারাত্মক জ্বরে আক্রান্ত হন এবং একদিনের মধ্যেই মারা যান।
বাবা মারা যাওয়ার পর ১৯০২ সালে কর্নেল হারল্যান্ড এর মা আবারো বিয়ে করেন এবং ইন্ডিয়ানার গ্রিনউড পরিবারসহ চলে যান। কিন্তু সৎ পিতার সাথে কর্নেলের সম্পর্ক মোটেও ভালো ছিল না। ফলে ১৯০৩ সালে স্কুল ছেড়ে একটি খামারে কাজ নেন। এরপর ইন্ডিয়ানার পুলিশ বাহিনীতে ঘোড়ার গাড়ি রঙ করার কাজ শুরু করেন। তার ১৪ বছর বয়সে একটি খামারে কাজ নেন এবং এখানে ২ বছর কাজ করেন। তিনি অনেকটা অস্থির মস্তিস্কের ছিলেন। হয়তবা অল্প বয়সের জন্য কোথাও বেশিদিন স্থির হতে পারছিলেন না।
১৯০৬ সালে তিনি তার এক চাচার মাধ্যমে একটি প্রস্তুতকারক প্রতিষ্টানে কন্ডাক্টরের কাজ পান। বছরখানেক কাজ করার পর আরেক চাচার মাধ্যমে দক্ষিন রেলরোডে একটি কামারশালায় কাজ পান। কিন্তু অস্থির মতির কর্নেলের এখানেও মন টেকে না। অল্প কিছুদিন কাজ করেই তিনি কয়লাচালিত একটি ট্রেনের ছাইয়ের ট্যাঙ্ক পরিষ্কারের কাজ শুরু করেন। পরবর্তীতে সেখানে ফায়ারম্যানের দায়িত্ব পান। এখানে বছর দুই কাজ করার পর তিনি রেলস্টেশনে দিনমজুরের কাজ নিন কিন্তু অস্থির মতির জন্য এখানেও বেশিদিন কাজ করতে পারেন না। তিনি আবারো রেলরোডে ফিরে যান এবং ফায়ারম্যানের কাজ শুরু করেন। বহুদিক ঘুরে ফিরে তিনি পড়ালেখা শুরু করার সিদ্ধান্ত নেন। এবং এক্সটেনশন বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিষয়ে পড়ালেখা শুরু করেন।
এই পর্যায়ে এসে কর্নেলের জীবন কিছুটা গুছানো হলেও এই গুছানো জীবন তার কপালে বেশীদিন সইলো না। সামান্য বিষয় নিয়ে সহকর্মীর সাথে দ্বন্দ্ব বেধে চাকুরিচ্যুত হন। কিন্তু ভাগ্যভাল আইন পড়াটা অব্যাহত রাখেন তিনি। আইন পড়া শেষ হলে তিনি কর্নেল “লিটল রক” নামে একটি আইন সম্পর্কিত প্রতিষ্ঠানে কাজ করে বেশ টাকা পয়াসা আয় করেন।
কিন্তু কর্নেলের পায়ে শিকলটানা এত সহজ কিছু না। অদৃষ্ট কর্নেলের জন্য অন্য কিছু ভেবে রেখেছিলেন। যার ভাগ্যে ছিল বিশ্ববিখ্যাত খ্যাতি, এই সামান্য আয়ে তার থেমে গেলে চলবে কেন। এই কারনেই হয়ত তার চঞ্চল মন এখানেও টিকলো না, ১৯১৬ সালে আইন পেশায় ইতি টেনে মায়ের কাছে ফিরে যান। এরপর তিনি জীবনবীমা কোম্পানি চাকুরি নিন কিন্তু সেখানে তার অবাধ্যতার কারনে বেশীদিন টিকতে পারেন নি। তবে এতে কর্নেলের খুব একটা সমস্যা হয় নি। ভবঘুরে কর্নেল অল্প সময়ের মধ্যেই নিউজার্সিতে একটি সেলসম্যানের কাজ জুটিয়ে নেন।
১৯২০ সালে কর্নেল একটি ডিঙ্গি নৌকা সরবরাহের কোম্পানি গড়ে তোলেন। তিনি ওহিও নদীতে চলার জন্য ডিঙ্গি সরবরাহ করতেন। এই ব্যবসার পাশাপাশি তিনি ইন্ডিয়ানার চেম্বারস অব কমার্সে কাজ করতেন। কিন্তু এটাও টেকশই হল না। বছর ঘুরতে না ঘুরতে চাকুরিও ছাড়লেন এবং নৌকার কোম্পানিও বিক্রি করে দিলেন।
এবার কর্নেল চলে যান কেন্টাকি রাজ্যের উইনচেষ্টারে। সেলসম্যানের চাকুরি জুটিয়ে নেন একটি টায়ার কোম্পানিতে। কিন্তু ১৯২৪ সালে কোম্পানিটি বন্ধ হয়ে গেলে কেন্টাকির স্ট্যান্ডার্ড অয়েল কোম্পানিতে একটি সার্ভিস সেন্টারে চাকুরি পান। কিন্তু দুর্ভাগ্য কর্নেলের যে এই স্টেশনটি ১৯৩০ সালে বন্ধ হয়ে যায়।
এই পর্যায়ে এসে কর্নেল সত্যই কিছুটা বিপদে পড়ে যান। এই সময় তিনি খাবার সরবরাহের কাজে যোগ দেন। এই সময় তার নিজের কোন রেস্তোরাঁ ছিল না। তিনি তার ঘর থেকেই এই কাজ করতেন। সুখের বিষয় হল তার তৈরি চিকেন ফ্রাই খুব অল্প সময়ের মধ্যেই জনপ্রিয়তা পেতে শুরু করে। ১৯৩৯ কর্নেল একটি মোটেল দেন ক্যারোলাইনার আশেভ্যালি কিন্তু মাত্র কয়েকমাসের মধ্যেই একটি ভয়াবহ অগ্নিকান্ড মোটেলটিকে পুরোপুরি ভস্মীভূত করে দেয়। কর্নেল থেমে না গিয়ে ওই মোটেলটিকেই ১৪০ আসনের একটি রেস্টুরেন্ট এ রুপ দেয়।
১৯৫২ সাল কর্নেলের জন্য একটি বিশেষ সময়। এই সময় তিনি তার বিখ্যাত ও জনপ্রিয় চিকেন ফ্রাই এর রেসিপিটিকে বানিজ্যিকভাবে আয়ের উৎসতে পরিনত করার সিদ্ধান্ত নেন। এই উদ্দেশ্যে তিনি একটি রেস্তোরাঁ খোলেন এবং সেটা ব্যাপকভাবে সফল হয়। এই রেসিপি এতটাই বেশি জনপ্রিয় হয় যে মাত্র ১০ বছরের মধ্যে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে কেএফসির ৬০০ টিরও বেশী শাখা খোলা হয়।
তার এই বিশেষ রেসিপিটি দেশে বিদেশে মানুষের মনে এমনভাবে যায়গা দখল করে যে আজও সে স্থান অন্য কোন খাবার দখল করতে পারে নি। সফলতা এমন একটি বিষয় যেটা কাউকেই এক-দুইবারে ধরা দেয় না। বহু পথ পাড়ি দিয়ে, বহু ব্যর্থতার পরেই সাফল্যের দেখা মেলে এটাই প্রমান করে গেছেন কেএফসির প্রতিষ্ঠাতা কর্নেল হারল্যান্ড ডেভিড স্যান্ডারস।