২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টের ছাত্র-জনতার সফল গণঅভ্যুত্থানের ফসল হচ্ছে বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। দীর্ঘ দেড় দশকের আন্দোলনের ফলে এই গণ আন্দোলন ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্ট মাসে সফল গণঅভ্যুত্থানে পূর্ণতা পেয়েছে।
বিগত দেড় দশক দেশে গণতন্ত্রের মোড়কে একটি নিপীড়নমূলক শাসন ব্যবস্থা চালু ছিল। কোন কোন অ্যাকাডেমিক এর মতে এ শাসন ব্যবস্থা মূলতঃ এক ব্যক্তির মাধ্যমে পরিচালিত হয়েছে। বাংলাদেশের শাসন ব্যবস্থার সংকট ঐতিহাসিক হলেও বিগত দেড় দশকের শাসন ব্যবস্থার প্রকৃতি ও রাজনৈতিক ব্যবহার পূর্বাপর শাসন ব্যবস্থা হতে একদম ব্যতিক্রম ছিল। রাষ্ট্র এতো সর্বাত্মকভাবে নিপীড়ক হয়েছিল যে এর তূলনা বিরল।
রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানসমূহের এতো নির্মম ভঙ্গুরতা আর কখনোই এতো স্পষ্টভাবে প্রতিভাত হয়নি। নিপীড়ক শাসন ব্যবস্থায় কৃষক-শ্রমিক-জেলে-কুমার থেকে শুরু করে শ্রমিক-দিনমজুর-কুলি, মধ্যবিত্ত, উচ্চ বিত্ত, রাজনৈতিক নেতা-কর্মী, ব্যবসায়ী, পেশাজীবী, সাংবাদিক, শিক্ষক-শিক্ষার্থীসহ সকলে নির্যাতনের মুখোমুখি হয়েছে।
নিপীড়নবাদী শাসন ব্যবস্থার অবশ্যাম্ভাবী ফল হিসেবে একটি বিশেষ ধনিক শ্রেণির তৈরি হয় যারা অর্থনৈতিক ব্যবস্থার উপর একচেটিয়া কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করে এবং অর্থনৈতিক নীতি-কাঠামোকে ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর অনুকূলে ব্যবহার করে। নজিরবিহীনভাবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক, যা জনগণের আমানত রক্ষায় প্রতিশ্রুতিবদ্ধ, ব্যাংকিং ব্যবস্থাকে পুরোপুরি একটি গোষ্ঠীর নিয়ন্ত্রণে আনুষ্ঠানিকভাবে দেয়ার সমস্ত আয়োজন সম্পন্ন করে। এটি শুধু বাংলাদেশের জন্য নয় পৃথিবীর অন্যান্য দেশের ইতিহাস বিবেচনায় নিলেও একটি বিরল ঘটনা। এমনকি অন্যান্য ভঙ্গুর গণতান্ত্রিক দেশেও এ ধরনের অভিজ্ঞতা নেই।
দেড় দশকের ব্যক্তি কেন্দ্রিক শাসন ব্যবস্থার আর একটি ভয়াবহ ফল হচ্ছে দেশে নির্বাচন ব্যবস্থাকে পুরোপুরি নস্যাৎ করে দেয়া। বাংলাদেশ ¯স্বাধীনতা লাভের পর আমরা কোন আদর্শ নির্বাচন ব্যবস্থা তৈরি করতে পারিনি। বাস্তব অর্থে ১৯৭৩ সালের জাতীয় নির্বাচনের মধ্য দিয়ে আমরা নির্বাচন ব্যবস্থা ধ্বংসের বীজ বপন করা হয়।
অতীত অভজ্ঞিতা উল্লেখ করে আলোচকরা বলেন, সংস্কার বা রুপান্তর হতে হবে জৈবিক বা অর্গানিক। কোন আরোপিত সংস্কার কোথাও কাজ করেনি। বাংলাদেশের বর্তমান রুপান্তর যেন কোন বিদেশী রাষ্ট্রের প্রকল্পের আওতায় না হয় তা নিশ্চিত করতে হবে। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ডেভলপমেন্টাল স্টেট এর অভিজ্ঞতা আমাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। জাপান, কোরিয়া, সিঙ্গাপুর, তাইওয়ান, মালয়েশিয়া, হালের ইন্দোনেশিয়া নিজ¯^ মডেলে উন্নয়ন এবং গণতান্ত্রায়ন করেছে। সিঙ্গাপুরের গণতান্ত্রায়ন নিয়ে প্রশ্ন থাকলেও জবাবদিহিতা, সচ্ছতা, প্রাতিষ্ঠানিক কার্যকারিতা নিয়ে কারো কোন প্রশ্ন নেই।
র্বতমান পরস্থিতিকিে ববিচেনায় নয়িে নম্নিোক্ত কিছু জরুরি করণীয়
আমরা আবারো বলছি রপান্তর হচ্ছে একটি রাজনৈতিক। তাই দীর্ঘ মেয়াদি রপান্তর রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার হাতে ন্যস্ত করা জরুরি। তবে যেহেতু বাংলাদেশ সমাজ বিগত ৫০ বছরে নানা ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে গেছে এবং সমাজ ও রাষ্ট্রীয় কাঠামোতে অনেক সংকট ও ভঙ্গুরতা ঘনীভূত হয়েছে, তাই আপাততঃ একটি গণতান্ত্রিক পাটাতন তৈরির জন্য কিছু গুরুত্বপূর্ণ অ্যাজেন্ডার উপর গুরুত্ব দেয়া প্রয়োজন। বড় উচ্চাকাংখা এক-এগারোর মতো পরিণতির দিকে নিতে পারে। যদি একটি শক্ত পাটাতন তৈরি করা সম্ভব হয় তাহলে দীর্ঘ মেয়াদে গণতান্ত্রিক রুপান্তর সহজ হবে। পাটাতন তৈরির প্রক্রিয়াকেও জৈবিক এবং জনগণের নেতৃত্বে করতে হবে। এ প্রেক্ষাপটে আমরা কিছু গুরত্বপূর্ণ প্রস্তাবনা উপস্থাপন করছি। এগুলো সামান্য ইঙ্গিত মাত্র। আরো ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ হতে পারে। আশা করি বিজ্ঞ প্যানেলিস্টগণ আরো বিশ্লেষণ করবেন এবং পরামর্শ দিবেন। তবে এটি মনে রাখা প্রয়োজন যে সংস্কার এমনভাবে করতে হবে যাতে রাজনৈতিক বৈধতা থাকে। সেজন্য ক্রিয়াশীল সকল রাজনৈতিক দলকে এ প্রক্রিয়ায় আনতে হবে। প্রয়োজন একটি চুক্তিপত্র বা অঙ্গীকারনামা ¯সাক্ষর করতে হবে যাতে ভবিষ্যতে কেউ অঙ্গীকার থেকে বিচ্যুত না হয়।
(১) সংবিধান সংস্কার
নানা মহল হতে এ বিষয়ে কথা উঠছে। তাই এ বিষয়ে স্পষ্ট কর্মপরিধিসহ কার্যকর পদক্ষেপ নেয়া প্রয়োজন। আমরা কোন সুনিদিষ্ট মতকে সমর্থন বা অসমর্থন করছি না। তবে মনে করি বিষয়টি নিয়ে স্পষ্ট পদক্ষেপ নেয়া প্রয়োজন। সংবিধানের গণতান্ত্রয়ানের সাথে জনগণের ক্ষমতায়ন জরুরি। ‘নাগরিক অধিকার’ ক্ষুন্য করে, এমন কিছু রহিত করা জরুরি। তাই, সংবিধান সংস্কার হবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক সংস্কার। আগামীর বাংলাদেশের ¯ স্বপ্ন যেন সংবিধান ধারণ করতে পারে তা নিশ্চিত করতে হবে।
(২) সকল প্রতিষ্ঠান যাতে ক্রিয়াশীল থাকতে পারে তার ব্যবস্থা করা
সকল পর্যায়ে, ভালো সময়ে বা মন্দ সময়ে, যাতে সরকারের প্রতিষ্ঠানসমূহ কাজ করতে পারে এবং রাজনৈতিকভাকে প্রভাবিত না হয়, সেজন্য কিছু রক্ষাকবচ তৈরি করতে হবে। উন্নত-উন্নয়নশীল দেশসমূহের উত্তম চর্চ্চাসমূহ বিশ্লেষণ করে পদক্ষেপ নেয়া প্রয়োজন। আমরা যদি সিভিল সার্ভিসকে বাঁচাতে পারি তাহলে অনেক সমস্যার সমাধান সম্ভব। ভারতে শুধু সিভিল সার্ভিসের কারণে এখনো মোটা দাগে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন সম্ভব হয়। অস্ট্রেলিয়ায় পাবলিক সার্ভিসকে রক্ষার জন্য ’মেরিট প্রটেকশন’ ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। আমরাও সব প্রতিষ্ঠানের জন্য কিছু ব্যবস্থা রাখতে পারি। রাষ্ট্র যদি কিছু ক্ষেত্রে আর্বিটারি পদক্ষেপ গ্রহণে বাধাগ্রস্থ হয় তাহলে এমনিতে শাসন ব্যবস্থায় উন্নতি হবে। কার্যকর প্রতিষ্ঠান ছাড়া কার্যকর রাষ্ট্র গঠন সম্ভব নয়। তাই সংস্কার প্রক্রিয়ায় প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা ও নৈর্ব্যক্তিকতাকে অগ্রাধিকার দিতে হবে।
(৩) যে কোন মূল্যে বিচার ব্যবস্থাকে রক্ষা করতে হবে
সংস্কারের একটি মূল লক্ষ্য হওয়া প্রয়োজন যে বিচার ব্যবস্থাকে, উচ্চ আদালত বা জেলা আদালত, যে কোন মূল্যে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ হতে রক্ষা করা। এটি সাংবিধানিক এবং প্রায়োগিক-উভয়ভাবে করতে হবে। উচ্চ আদালতে নিয়োগে মেরিটোক্রেসি এবং নির্দিষ্ট কিছু স্পষ্ট ও বাস্তবায়নযোগ্য শর্ত দিতে হবে। ¯স্বাধীন বিচার ব্যবস্থার সাথে বিদেশী বিনিয়োগ, রাজনৈতিক অধিকার, সুশাসন, মানবাধিকার ইত্যাদি সবকিছু জড়িত।
(৪) কার্যকর সরকারের জন্য বর্তমান প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা সংস্কার করা
বর্তমানে সরকারের অনেক প্রতিষ্ঠান সময়ের বিবর্তনে কার্যকারিতা হারিয়েছে। আবার অনেক ক্ষেত্রে নতুন প্রতিষ্ঠান তৈরির প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছে। তাই দ্রুত একটি সংস্কার কার্যক্রম গ্রহণ করা প্রয়োজন যাতে রাষ্ট্রের সাইজ সঠিক অবস্থায় আনা যায়। বর্তমানে বাজেটের সিংহভাগ বেতন-ভাতায় যায়। এ থেকে নিষ্কৃতি পেতে হলে রাষ্ট্রের সঠিক সাইজ নির্ধারণ করতে হবে। ফলে সরকারের প্রতিষ্ঠানসমূহের বর্তমান অবস্থা ও প্রয়োজনীয়তা পর্যালোচনা করে ব্যবস্থা গ্রহণ করা দরকার। এটি একটি অন্যতম আশু করণীয়।
(৫) শিক্ষা ও স্বাস্থ্য ব্যাপক সংস্কার দরকার
কার্যকর শিক্ষা ও স্বাস্থ্য ব্যবস্থার জন্য যথাযথ ডায়াগনস্টিক করে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। একদম নির্মোহভাবে এসব পদক্ষেপ নিতে হবে। স্বাস্থ্য ও শিক্ষায় ব্যয় মেটাতে গিয়ে অনেকে গরীব হচ্ছে। এশিয়ার যেসব দেশ এসব ক্ষেত্রে সফল হয়েছে সেসব উদাহরণ বিবেচনায় নিতে হবে।
(৬) যে কোন চুক্তি (রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, কূটনৈতিক) পাবলিক করা এবং সংসদীয় আলোচনায় আনা
দ্বিপাক্ষিক ও বহুপাক্ষিক চুক্তিসমূহকে প্রকাশ করতে হবে এবং সংসদীয় বিতর্কে নিতে হবে।
(৭) দক্ষিণ এশিয়ার পরিবর্তন চিহ্ন বুঝা
আপাততঃ অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক সংস্কারের সাথে সম্পর্কিত মনে না হলেও বৃহত্তর অর্থে এবং দীর্ঘ মেয়াদে দক্ষিণ এশিয়ার পরিবর্তন রেখা বুঝা এবং উপলব্ধি করা জরুরি। এ পরিবর্তনের আলোকে বাংলাদেশকে বহুপাক্ষিক ব্যবস্থাকে গুরুত্বের সাথে বিবেচনায় নিতে হবে।
সেন্টার ফর পলিসি এ্যানালাইসিস অ্যান্ড অ্যাডভোকেসি (সিপিএএ) এর উদ্যোগে আজ (২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪) রোজ শনিবার ঢাকা রিপোটার্স ইউনিটি’র (ডিআরইউ) নসরুল হামদি মলিনায়তনে ‘আগামীর বাংলাদেশঃ জনগণের ক্ষমতায়ন ও কার্যকর রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা–নাগরিক ভাবনা’ শীর্ষক একটি গোলা টেবিল আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়। উক্ত গোলটবেলি আলোচনায় মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করনে ঢাকা বশ্বিবদ্যিালয়রে রাষ্ট্রবজ্ঞিান বভিাগরে সহযোগী অধ্যাপক শরীফুল ইসলাম, সিলেট শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবজ্ঞিান বিভাগের প্রফেসর ড. নজরুল ইসলাম ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফসের ড. শফিউল ইসলাম। সভায় সভাপতত্বি করনে সপিএিএ-এর ্প্রেসিডেন্ট ড. শরীফুল আলম।
আলোচনায় অংশগ্রহণ করনে অবসরপ্রাপ্ত বিচারক ইকতদোর আহমদে, পরিবেশ বিজ্ঞানী ড. ফজলে রাব্বী সাদকে আহমদে, সুপ্রিম কোর্টের আইনজিবী ব্যারিস্টার ফয়েজ আহমদে, গাম্বয়িার ইন্টারন্যাশনাল ওপনে ইউনভিারসটিরি প্রফসের আফরােজা বুলবুল, ব্র্যাক ইনস্ট্রটিউিট অব গভরনন্সে ড. মির্জা হাসান, সাংবাদিক সোহরাব হাসান, চক্ষু বিশেষজ্ঞ প্রফসের শাহ বুলবুল ইসলাম, ইউকে ওপেন ইউনিভার্সিটির ড. নাবিলা ইদ্রিস, সাংবাদিক আসজাদুল কিবরিয়া, বিশিষ্ট ইসলামী চিন্তাবিদ ড. মীর মানজুর মাহমুদ, প্রফেসর মোঃ আতিয়ার রহমান, গবষেক আলী আহসান জুনায়েদসহ দেশী-বিদেশী বরণ্য শিক্ষাবিদ, একাডেমিক, সাংবাদিক, কলামিস্ট, বিচারক (অবঃ), আইনবিদ, পেশাজীবিসহ বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ। আলোচনা সভা পরচিালনা করেন জুনায়েদ মাসরুর খান।