বাসা- অত্যন্ত আপন একটি স্থান গৃহকোন ভালোবাসার। যে বাড়ীর মাঝে অবসর সময় কাটে অন্তরালে। আবার গৃহই হল আত্মীয়তার সূত্রে বাঁধা আত্মিক একটি স্থান। সারাদিন কর্ম কোলাহল মুখর এই শহরের যেখানে যান্ত্রিকতার শেষ নেই তারই অন্তরালে আমরা খুঁজে নেই আমাদের আপন গৃহকে। যেই গৃহের আনাচে কানাচে সর্বত্রই থাকে মায়া মমতা আর ভালোবাসার ছোয়া। একজন ব্যাক্তি যতই কর্মব্যস্ত হোক না কেন দিন শেষে গৃহে ফিরে যায় তার নিজস্ব জগতে নিজস্ব গৃহকোনে। একটি সুখী গৃহকোন একজন ব্যাক্তির মানসিকতায় দারুন প্রভাব ফেলে।
একজন দক্ষ স্থপতিকে একটি গৃহ নকশায় তার ক্লাইন্টের পরিবারের সদস্য, তাদের বয়স এবং স্বাস্থ্য অনুযায়ী গৃহনকশার পরিপূর্নতার জন্য সম্পূর্নভাবে জানা দরকার। স্থাপত্য পেশায় আমি যখন শিক্ষানবীশ ছিলাম তখন মনোবিজ্ঞান বিষয়টি ছিল। তখন পুরোপুরি ভাবে না বুঝলেও পরবর্তীতে যখন কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ করলাম তখন মানসিকতার সাথে একটি গৃহ ডিজাইনের সম্পূর্ণতা গুরুত্বপূর্ণভাবে জড়িত। একটি সার্বিক স্থাপত্য নকশায় গৃহনকশার সম্পূর্ণতার ছোয়া অবশ্যই পারিবারিকভাবে ভীষন প্রভাব ফেলে।
একটি বাড়ী, একটি স্বপ্ন পূরনের জায়গা। একটি বাড়ীর গৃহ সদস্যদের মাঝে থাকে স্বামী-স্ত্রী, সন্তান অনেক সময় বয়োজ্যেষ্ঠ (দাদা-দাদী, নানা-নানী অথবা ঘনিষ্ট যেকোন আত্মীয়-স্বজন)।
খনার বচন
দক্ষিণ-দুয়ারী ঘরের রাজা,
পূর্ব-দুয়ারী তাহার প্রজা।
পশ্চিম-দুয়ারীর মুখে ছাই,
উত্তর-দুয়ারীর খাজনা নাই।
এখান হতেই প্রতিভাত হয় যে বাড়ী নকশায় মানসিক স্বাস্থ্যের প্রভাব কতটুকু। এবার আসা যাক গৃহ নকশায় বায়ু প্রবাহের দিক নিয়ে। আমাদের দেশে বায়ুপ্রবাহ প্রধানত দক্ষিন-পূর্বমুখী। যে বাড়ীর দক্ষিন-পূর্ব দিকে খোলা – সেখান হতে আলো রোদের বিশাল ছড়াছড়ি স্বাস্থ্যগত দিকে চিন্তা করলে যে বাড়ীতে আলো বাতাস পরিপূর্ণ সেখানে রোগব্যাধি তত কম, যা শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত ভালো। শরীর ভালো তো মনও ভালো।
সকালের সোনাঝরা রোদের ছোট একটি ব্যালকনি যদি দক্ষিন/পূর্বমুখী হয় তবে দিনই শুরু হয় আলোকোজ্জল ও ঐজোল্ল্যময়তা দিয়ে। দিনের শুরু যার আলো দিয়ে মনও তার ফুর্তিতে পরিপূর্ন থাকে। আবার পশ্চিমের ঘর বিকেলে অত্যন্ত উত্তপ্ত হয়ে উঠে যা গৃহকে গরম করে এবং তা শারীরিকভাবেও প্রতিক্রিয়া তৈরি করে। যে বাড়ী ছোট সেখানে দেয়াল হালকা রঙ ও আসবাবপত্র কম হওয়া উচিৎ, অল্পের মধ্যে প্রয়োজনীয় সকল জিনিস স্থান পেলে ঘর খোলামেলা লাগবে, যা চোখ ও মনকে করবে প্রফুল্ল। ছোট বাড়ীতে খোলামেলা ড্রইং- ডাইনিং হওয়া উচিৎ, যা অগ্রগণ্য। মানসিক যোগাযোগ সম্ভব খোলামেলা বসার ও খাওয়ার ঘর একই সাথে খোলা রান্নাঘরের মাধ্যমে
একজন মা অনেকটা সময় রান্নাঘরে ব্যয় করে ওপেন লেআউট রান্নাঘর হলে তা পরিবারের সকলের মধ্যে কর্মস্পৃহা ও সহযোগীতার মানসিকতা তৈরি করে। অনেক দক্ষতা সন্তানেরা মা হতে অর্জন করে যা পরবর্তী জীবনে তাদের মানসিক বৃদ্ধিতে সহায়তা করে।
গৃহে যদি থাকে বাতাস আলোর ছড়াছড়ি তা হৃদয়কে করে আন্দোলিত সুস্বাস্থ্যের মানসিকতার প্রভাব ফেলে অন্তরীম। ঘরের ব্যালকনিতে থাকুক সবুজের ছোয়া। বাতাস পত্রপল্লবের হাতছানি মনকে অনেক উদাস করে দেয় মানসিক বন্ধন তৈরী হয় প্রকৃতির সাথে সবুজের মাঝে। একটুকরা আকাশ হোক বিকেলের ছাদে সর্বক্ষন, বেলায় বেলায় আকাশের রুপ পরিবর্তন মনকেও অনেক সতেজ করে।
একটি সুন্দর পরিপূর্ণ গৃহ নকশা সবসময়ই মানসিক শান্তি ও বিকাশে অপরিহার্য্য। আমরা প্রয়োজন অনুসারে যেখানেই নকশা করি না কেন পরিবারের সদস্যদের বয়স অনুপাতে তার সমন্বয় করতে হবে। শিশুর জন্য রঙ্গিন ঘর, সাথে তার উপযোগী ফার্নিচার দেবে তাকে মানসিক স্বস্তি। বয়জ্যেষ্ঠদের রুমের টয়লেট হোক হুইল চেয়ার এ্যাকশেসিবিলিটি আর সেইসাথে তাদের পছন্দ অনুযায়ী ঘরটি সজ্জিত হোক যা তাদেরকে স্বাচ্ছন্দ্য দেবে।
খোলা জানালা অথবা বারান্দা হতে আমরা দেখতে চাই সকালের সোনা রোদ্দুর, দুপুরের সূর্য, বিকেলের গোধূলী আর সন্ধ্যার তারা। আমাদের জীবনের প্রতিদিন হোক সজীব যান্ত্রিকতার এই শহরে মানসিক ও পারিবারিক মেলবন্ধন। একটুকরা মেঘলা আকাশ, উদাস করা বাতাস, সবুজের হাতছানি আমাদের মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নয়নে ছাপ ফেলে। ঘরের ইনটেরিয়রে থাকুক সবুজের প্রভাব, রাতের আকাশের তারা দেখতে চাই আমরা আমাদের জানালা ও ব্যালকনি দিয়ে।
বিকেলের আলো ছায়ায় কফির মগের উদ্দামতায় আমরা যেন মেতে উঠি আনন্দে। আর তারা ঝরা রাতের ঋতুর পালায় গাছপালার সংগ্রহে ফুটে উঠুক আমাদের আগামী জীবন। প্রত্যাশা হোক তাদের সুস্থাস্থ্যের আর ভালোবাসায়। বাসা হোক স্বাচ্ছন্দ্যময়-ঋতুময়-প্রকৃতিময় ও ভালোবাসাময় এবং জীবন হোক গতিশীল সুন্দর। একটি বাসা স্বাচ্ছন্দ্য আনে, আনে মানসিক স্বস্তি। আগামীর স্বপ্নে সুস্থ্য, শারীরিক ও মানসিক উজ্জিবনি জীবনের প্রচেষ্টায় আমরা সকলে।
স্থপতি মোমেনুন্নেসা (আলফা)
বি. আর্ক (বুয়েট), এমএসইএস,
এমআইএবি
মোবাইল: ০১৭১২১৭৬২৯৯
ই-মেইল: momenunnessa@yahoo.com