বাংলাদেশের অর্থনীতি এখন বেশ স্থিতিশীল কিন্তু বৈশ্বিক ভূ-অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জের কারণে বর্তমান অবস্থা আত্মতৃপ্তিতে ভোগার সুযোগ নেই। বাংলাদেশ সরকারের মাননীয় পরিকল্পনামন্ত্রী এম.এ.মান্নান, এম.পি. পহেলা এপ্রিল ২০২৩ তারিখে গুলশান ক্লাবে বাংলাদেশ মালয়েশিয়া চেম্বার অফ কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি কর্তৃক আয়োজিত এবং জিডি অ্যাসিস্টের পরিচালনায় প্রাক-বাজেট (২০২৩-২৪) আলোচনা সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে একথা বলেন।
মাননীয় পরিকল্পনামন্ত্রী বলেন, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, বিশ্বব্যাপী জ্বালানি মূল্য বৃদ্ধি এবং ইউএস ফেডের সুদের হার বৃদ্ধি আমাদের অর্থনীতিতে প্রভাব ফেলেছে। তিনি বলেন, এসব কারণে বাংলাদেশ ব্যাংক আমদানি ও এলসি খোলার ক্ষেত্রে সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নিয়েছে এবং এ কারণেই আমাদের রিজার্ভ এখনও বেশ স্থিতিশীল রয়েছে। তিনি আরও বলেন, যেহেতু আমাদের কর-জিডিপি অনুপাত সন্তোষজনক নয় এবং আমাদের রাজস্ব আদায়ও কম, তাই কর নেট বাড়ানো ছাড়া আমাদের আর কোনো বিকল্প নেই। তিনি ট্যাক্স স্বয়ংক্রিয়করণ, কর ব্যবস্থার সরলীকরণ এবং প্রযুক্তি ব্যবহারের গুরুত্ব তুলে ধরেন। মন্ত্রী বলেন, কৃষি, চামড়া, লাইট ইঞ্জিনিয়ারিং, ফার্মাসিউটিক্যালস এবং অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ খাতে আরএমজি সেক্টরের মতো সুবিধা পাওয়া উচিত। তিনি এলডিসি গ্রাজুয়েশনের পর প্রতিযোগিতামূলক হতে আমাদের রপ্তানিযোগ্য পণ্যের পণ্য বৈচিত্র্যের ওপর জোর দেন। তাছাড়া বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দা ও অস্থিতিশীলতা বিবেচনায় আগামী বাজেট অতি উচ্চাভিলাষী হবে না বলেও জানান তিনি। তিনি বলেন, রেমিট্যান্স, রপ্তানি, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ এবং এফডিআই-এর মতো সব সূচকেই গত ছয় মাসে বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি নেতিবাচক ছিল না।
অনুষ্ঠানে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশের নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর। ড. মনসুর তার উপস্থাপনায় উচ্চ মূল্যস্ফীতি এবং ক্রমাগত ডলার সংকটের কারণে বাজেট প্রণয়নে সামষ্টিক অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তার কথা বলেন। সার্বিক স্থিতিশীলতার জন্য, সরকারকে আসছে বাজেটে দ্বিতীয় প্রজন্মের বেশ কয়েকটি সংস্কার শুরু করতে হবে। তিনি বলেন, সরকারকে ব্যাংকিং ও আর্থিক খাত, বাণিজ্য সুবিধা, বাণিজ্য নীতি সংস্কার, শহুরে বাসিন্দাদের জন্য সাশ্রয়ী মূল্যের সবুজ আবাসন ইত্যাদির মতো ক্ষেত্রগুলিতে একাধিক কাঠামোগত সংস্কার কর্মসূচি গ্রহণ করতে হবে। তিনি আরও যোগ করেছেন যে উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে অনেক ক্ষেত্রে প্রকৃত মজুরি হ্রাসের সাথে পরিবারের চাহিদা হ্রাস পাবে। তবে পরিস্থিতি সামাল দিতে তিনি সরকারের নেওয়া পদক্ষেপের প্রশংসা করেছেন। তিনি বলেন, বাজেটে সামাজিক ব্যয় সংরক্ষন করতে হবে। তিনি বলেন, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বাজেট ঘাটতি একটি সাধারণ ঘটনা। তাই, বাজেট ঘাটতি পূরনের জন্য সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত এবং কাঠামোগত সংস্কার করা উচিত।
বিএমসিসিআই সভাপতি সৈয়দ আলমাস কবির অতিথিদের স্বাগত জানান এবং অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন। তিনি বর্তমান মুদ্রাস্ফীতি এবং জীবনযাত্রার ব্যয় বিবেচনা করে ব্যক্তির জন্য করমুক্ত আয়ের সীমা বর্তমান ৩ লাখ থেকে ৫ লাখে উন্নীত করার অনুরোধ জানান। ২০৪১ সাল পর্যন্ত অবকাঠামো খাতে বাংলাদেশের প্রায় ৬০৯ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বিনিয়োগের প্রয়োজন হবে। এবারের বাজেটে আয়কর ও মূল্য সংযোজন করের পরিধি বাড়ানো, আয়কর সংগ্রহে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা, কর ব্যবস্থার সম্পূর্ণ স্বয়ংক্রিয়তা, রপ্তানি বহুমুখীকরণ, স্থানীয় শিল্পায়নকে উৎসাহিত করা এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জনে বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ নিশ্চিত করার ওপর গুরুত্ব দেওয়া উচিত। আলমাস কবির করের হার না বাড়িয়ে করদাতার সংখ্যা বাড়ানোর আহ্বান জানান।
অনুষ্ঠানে বাজেট নিয়ে নিজেদের বক্তব্য তুলে ধরেন ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (এফবিসিসিআই) সহ-সভাপতি এম এ মোমেন, ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি এর সভাপতি ব্যারিস্টার সমীর সাত্তার, লেদারগুডস অ্যান্ড ফুটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (এলএফএমইএবি) এর সভাপতি সৈয়দ নাসিম মঞ্জুর, বাংলাদেশ চেম্বার অব ইন্ডাস্ট্রিজ এর সভাপতি আনোয়ারুল আলম চৌধুরী, বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশন (বিটিএমএ) এর সভাপতি জনাব মোহাম্মদ আলী খোকন, এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান এবং সিয়াকো ফাউন্ডেশনের উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ আব্দুল মজিদ।
এফবিসিসিআই সহ-সভাপতি এম এ মোমেন বলেন, করের হার কমিয়ে কর আদায়ের পরিধি বাড়াতে হবে। অর্থাৎ শুধু রাজধানী ও চট্টগ্রাম নয়, সারাদেশের উপজেলা পর্যায়েও কর আদায় নিশ্চিত করতে হবে। এ সময় তিনি বলেন, যারা কর আদায় করবেন এবং যারা কর নীতিমালা করবেন তাদের আলাদা হতে হবে। তিনি বলেন, যারা কর নীতি করছেন তারা আদায় করছেন তা হতে পারে না।
ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি ব্যারিস্টার সমীর সাত্তার অবকাঠামো উন্নয়নের জন্য প্রয়োজনীয় একটি আর্থিক পরিকল্পনা প্রণয়নের আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি বলেন, ঢাকা ও চট্টগ্রামের বাইরে বসবাসকারী ব্যক্তিদের অন্তর্ভুক্ত করার জন্য কর সংগ্রহের আওতা আরও প্রশস্ত করা উচিত কারণ বেশিরভাগ কর সংগ্রহ ঢাকা আর চট্টগ্রাম থেকেই হয়। তিনি দেশে ট্যাক্সেশন এবং ভ্যাট ইকোসিস্টেম সম্পূর্ণ স্বয়ংক্রিয়করণ নিশ্চিত করার জন্য একটি “একটি সমন্বিত কর প্রশাসন ব্যবস্থা” এবং “সমন্বিত ভ্যাট প্রশাসন ব্যবস্থা” সুপারিশ করেন।
বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মোহাম্মদ আলী খোকন বলেন, সারাদেশে সাড়ে তিন কোটি মানুষ হোল্ডিং ট্যাক্স দেন। অন্যদিকে আয়কর দেন মাত্র ২০ লাখ থেকে ৩০ লাখ মানুষ। ব্যবসায়ীদের ওপর সব কর আরোপ করা যায় না। তিনি করের হার কমানো, এর পরিধি বাড়ানো এবং আদায় নিশ্চিত করার পরামর্শ দেন।
লেদারগুডস অ্যান্ড ফুটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (এলএফএমইএবি) সভাপতি সৈয়দ নাসিম মঞ্জুর কর ব্যবস্থাকে সহজীকরণ এবং বেসরকারি খাতের সুবিধার্থে কর সংস্কারের আহ্বান জানিয়েছেন যাতে ব্যবসায়ীরা আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করতে পারে। তিনি এনবিআরকে অন্তত আগামী পাঁচ বছরের জন্য করের হার স্থিতিশীল রাখার আহ্বান জানান, কারণ করের হার ঘন ঘন পরিবর্তন ব্যবসায়ীদের মধ্যে বিরক্তি ও আতংকের উদ্রেক করে। তিনি বলেন, যারা কর দেন তাদের ওপরই করের বোঝা চাপানো হয়। এতে করে যারা কর দিচ্ছেন তারা কর দেওয়ার আগ্রহ হারিয়ে ফেলবেন। আবার জনগণ করের আওতায় আসতে চাইবে না। তিনি ব্যবসা করার ব্যয় যাতে না বাড়ে সেদিকেও সতর্ক হওয়ার প্রতি আহবান জানান।
বাংলাদেশ চেম্বার অব ইন্ডাস্ট্রিজের সভাপতি আনোয়ারুল আলম চৌধুরী বলেছেন, সরকারি আয়ের একটি বড় অংশ বেসরকারি খাত জোগান দিচ্ছে জনগণের জন্য এবং এনবিআর এই আয় মূলত বেসরকারি খাত থেকে সংগ্রহ করছে। কিন্তু এনবিআরের কিছু পদক্ষেপ সরকার ও বেসরকারি খাতের মধ্যে আস্থার সংকট তৈরি করছে। কারণ জ্বালানি খরচ বেড়েছে এবং শ্রম আগের মতো সস্তা নয়। তাই বেসরকারি খাতের প্রবৃদ্ধি কমেছে, বর্তমান পরিস্থিতিতে নতুন বিনিয়োগ বাড়ছে না। কিন্তু এই খাত শুধু মুনাফা করছে বলে ধরে নিয়ে বেসরকারি খাতের ওপরে বারবার কর আরোপ করা হলে ভবিষ্যতে ব্যবসায়ীরা বিনিয়োগে আগ্রহ হারাবে এবং প্রবৃদ্ধি আরও কমে যাবে।
এনবিআর-এর প্রাক্তন চেয়ারম্যান ডঃ আব্দুল মজিদ বিএমসিসিআইকে এমন একটি সময়োপযোগী অনুষ্ঠানের আয়োজন করার জন্য ধন্যবাদ জানান এবং ব্যবসায়ীদের প্রত্যেকটি সুপারিশকে অত্যন্ত যৌক্তিক বলে উল্লেখ করেন। বিএমসিসিআইকে ব্যবসায়ী নেতাদের সুপারিশ বিবেচনার জন্য এনবিআরের কাছে প্রস্তাব করার জন্য বলেন যাতে তা আসন্ন জাতীয় বাজেট ২০২৩-২৪ এর সাথে যুক্ত করা যায়।
বক্তারা কর ব্যবস্থার অভ্যন্তরীণ সম্পদ সংগ্রহ এবং ডিজিটাইজেশন বা অটোমেশনের ওপর জোর দেন। তারা কর জাল প্রশস্তকরণ, কর সংস্কার, কর-জিডিপি অনুপাত বৃদ্ধি, ট্যাক্স সহজীকরণ, দীর্ঘমেয়াদী অর্থায়নের জন্য বন্ড মার্কেটের উন্নয়ন, টেকসই পুঁজিবাজার উন্নয়ন, এসএমই সুরক্ষা, পশ্চাৎপদ সংযোগ শিল্পের উন্নতি, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ, খাদ্য নিশ্চিত করার আহ্বান জানান। নিরাপত্তা, কর্পোরেট ট্যাক্স হ্রাস, সমস্ত রপ্তানিমুখী শিল্পের জন্য বন্ড সুবিধা, পণ্য বৈচিত্র্যকরণ, বাজার বৈচিত্র্যকরণ, পিটিএ এবং এফটিএ স্বাক্ষর, শুল্ক ও অশুল্ক বাধা অপসারণ ইত্যাদি বিষয়ে আলোকপাত করেন।
প্রাক-বাজেট আলোচনায় মালয়েশিয়ার মাননীয় হাইকমিশনার হাজনাহ মোঃ হাশিম সম্মানিত অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন। অনুষ্ঠানে আরও উপস্থিত ছিলেন বিএমসিসিআই-এর সম্মানিত সাবেক সভাপতি, পরিচালকবৃন্দ। অনুষ্ঠান শেষে সৈয়দ আলমাস কবীর উপস্থিত সকলকে ধন্যবাদ জানান এবং অনুষ্ঠানে পাওয়া ব্যবসায়ী নেতাদের সকল সুপারিশ এনবিআরে পাঠানোর আশ্বাস দেন।
——
প্রেস বিজ্ঞপ্তি