নেটফ্লিক্স অনলাইন ভিডিও স্ট্রিমিং জগতের এক সুপরিচিত নাম। সিনেমা, টেলিভিশন সিরিজ দেখতে ভালোবাসে কিন্তু নেটফ্লিক্স চেনে না এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া মুশকিল। বর্তমানে এই ভিডিও স্ট্রিমিং সাইটের গ্রাহক সংখ্যা প্রায় ১২ কোটিরও বেশি! বছরে আয় করছে বিলিয়ন ডলার। তুমুল জনপ্রিয় সাইট নেটফ্লিক্স একদিনে এই জায়গায় আসেনি। জনপ্রিয়তার শীর্ষে উঠতে তাদের পাড়ি দিতে হয়েছে দীর্ঘ পথ।
নেটফ্লিক্সের পথ চলা শুরু হয় ১৯৯৭ সালে রিড হেসটিংস ও মার্ক রুডলফ এর হাত ধরে। তবে নেটফ্লিক্স শুরু করার চিন্তা প্রথমে রিড হেসটিংসের মাথায় আসে। তিনি আশির দশকে স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় প্রথম এধরণের কিছু প্রতিষ্ঠা করার কথা ভাবতে শুরু করেন৷ সেসময়ে সিনেমার সোনালী যুগ ছিলো বলা যায়। মানুষ তখন অবসরে সিনেমা দেখতে পছন্দ করতো। যারা সিনেমা হলে গিয়ে সিনেমা দেখতে পারতেন না তাদের জন্য ঘরে বসে সিনেমা দেখার সুযোগ করে দিয়েছিলো ব্লকবাস্টার। সেসময়ে ব্লকবাস্টার ছিলো খুবই জনপ্রিয়। পুরো আমেরিকা জুড়ে তাদের শাখা ছিলো। তাদের থেকে গ্রাহকরা ডিভিডি ভাড়া করে দেখতে পারতো।
তবে ব্লকবাস্টার গ্রাহকদের ভালো মানের সেবা দিলেও তাদের সমস্যা ছিলো সীমিত সময়। অর্থাৎ শুধু একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্তই গ্রাহকরা ডিভিডি নিজেদের কাছে রাখতে পারতো এবং সেই সময় ছিলো খুবই কম। নির্দিষ্ট সময়ের পরে ডিভিডি দিলে জরিমানা গুণতে হতো। একবার রিড হেসটিংসকেও ব্লকবাস্টার থেকে ডিভিডি ভাড়া করে এমন জরিমানা গুনতে হয়েছিলো। সেই থেকে তার মাথায় আসে আরো কিভাবে সহজভাবে গ্রাহকদের কাছে ডিভিডি পৌছে দেয়া যায়। এবং এই চিন্তা থেকেই তিনি শুরু করেন নেটফ্লিক্স।
শুরুর দিকে নেটফ্লিক্সের গ্রাহক সংখ্যা ছিলো খুবই কম কিন্তু ধীরে ধীরে মানুষ নেটফ্লিক্সকে পছন্দ করতে শুরু করে। কারণ নেটফ্লিক্স ব্লকবাস্টারের মতো সীমিত সময়ের জন্য ডিভিডি সরবরাহ করতো না বরং একটি নির্দিষ্ট মাসিক ফি দিলে পুরো মাস একাধিক ডিভিডি গ্রাহকরা সংগ্রহ করতে পারতেন। এছাড়া নেটফ্লিক্স ডাকযোগে ডিভিডি পাঠানোর ব্যবস্থা করে যাতে ঘরে বসে গ্রাহকরা ডিভিডি সংগ্রহ করতে পারে। মজার ব্যাপার হচ্ছে ২০০০সালের দিকে নেটফ্লিক্সের প্রতিষ্ঠাতারা ব্লকবাস্টারের মালিক জন এন্টিকোকে ৫০মিলিয়ন ডলারে নেটফ্লিক্স কিনে নেয়ার প্রস্তাব দেয় কিন্তু জন সেই প্রস্তাব ফিরিয়ে দেন। আর এখন নেটফ্লিক্স বছরে বিলিয়ন ডলারের ব্যবসা করে আর ব্লকবাস্টারের অস্তিত্বই প্রায় টিকে নেই বললেই চলে।
২০০০ সালের পর থেকে নেটফ্লিক্স উত্থানই দেখছিলো। ২০০৫ সালের দিকে নেটফ্লিক্স প্রায় মিলিয়ন ডিভিডি গ্রাহকদের সরবরাহ করতো। এর বছর দুয়েক পরে তারা অনলাইন ভিডিও স্ট্রিমিং শুরু করে যা দ্রুতই খুব জনপ্রিয় হয়।
সমস্যার শুরু হয় ২০১১সালে। রিড হেসটিংস হঠাৎ করে একটি নতুন পদক্ষেপ নেন। ভিডিও স্ট্রিমিং আর ডিভিডি ব্যবহারকারীদের সাবস্ক্রিপশন ব্যবস্থা আলাদা করে দেন আলাদা দামের মাধ্যমে। গ্রাহকরা এতে নারাজ হন এবং অতি দ্রুত নেটফ্লিক্স অন্তত আট লক্ষ গ্রাহক হারায়। এতে দ্রুতই নেটফ্লিক্সের বাজার দাম কমতে থাকে। অনেকেই রিড হেসটিংস এর এই পদক্ষেপ ও নেটফ্লিক্সের এই দ্রুত পতন নিয়ে সমালোচনা ও হাসাহাসি করতে থাকেন। তারপরের কয়েক বছর নেটফ্লিক্সের জন্য ছিলো সেই শুরুর বছরগুলোর মতো। একের পর এক ভুল পদক্ষেপে সবাই ধরে নিয়েছিলো নেটফ্লিক্স আর মাথা উঁচু করে দাড়াতে পারবেনা। এর কিছুদিন পরেই ২০১৩ সালে নেটফ্লিক্স নিজস্ব কন্টেন্ট নিয়ে হাজির হয়। নেটফ্লিক্স অরিজিনালের প্রথম টিভি সিরিজ হাউজ অব কার্ড ভীষণ জনপ্রিয়তা পায়। গ্রাহকরা আবার নেটফ্লিক্সের দিকে আগ্রহ ফিরে পেতে শুরু করে। পরবর্তীতে নেটফ্লিক্স নিজেদের আরো কিছু কন্টেন্ট নিয়ে হাজির হয় যেগুলো সবই কমবেশি জনপ্রিয়তা পায়। তারপর থেকে নেটফ্লিক্সকে আর ফিরে তাকাতে হয়নি। কোটি কোটি গ্রাহক এখন নেটফ্লিক্সের। বিলিয়ন ডলারের ব্যবসা করে তারা বছরে।
২০১৮ সালে তারা ১২বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করেছিলো নিজেদের কন্টেন্টের জন্য। এবছর বিনিয়োগের পরিমাণ আরো বাড়ার কথা। হাজারো চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে ছোট্ট ডিভিডি ব্যবসার দোকান থেকে নেটফ্লিক্স এখন পৃথিবীর এক নাম্বার অনলাইন ভিডিও স্ট্রিমিং সাইট। তবে তারা তাদের ডিভিডির ব্যবসা এখনো বন্ধ করেনি। আমেরিকা জুড়ে এখনো রয়েছে তাদের ১৭টি ডিভিডি বিতরণ কেন্দ্র।