বেড়াতে যাওয়া আমাদের পারিবারিক আবহ। যেহেতু বাচ্চাদের পরীক্ষা সামনে তাই খুবই বিধিনিষেধ ও কড়াকড়ির মধ্য দিয়ে সময় যাচ্ছিল। সেইসময় বন্ধু বিথীর আহ্বানে সাড়া দেয়া। “গ্রাম ছাড়া ঐ রাঙা মাটির পথ” আমরা হলাম সওয়ার। রেবেকা বিথী ও তাঁর পতিদেব সিদ্দিক ভাই এবং আমরা-আমি, মাহবুব ও আমার তিন কন্যা। কুয়াশা ঢাকা ভোরে-যখন ঢাকা চাদোয়ায় ঢাকা ঠিক তখনি আমরা রওয়ানা করি।
সকাল আট ঘটিকায় রেডী হয়ে আমরা হাজির হলাম বন্ধুর বাসার দোড়গোড়ায়। বন্ধুকে ফোনে জানালাম “বান্দা হাজির”, উনি কি বললেন” কাপের শেষ চুমুকটুকু দিয়ে নামছি”- সত্যি কথা আমারও ইচ্ছে হচ্ছিল ১ কাপ চা খাই যদি বন্ধু আহ্বান করেছিল তবু সকাল সকাল ইচ্ছে করছিল না কাউকে ডিস্ট্রাব করতে।
অপেক্ষার পালা শেষ বন্ধু তার স্বামী নিয়ে গাড়ীতে বসলো। এবার যাত্রা শুরু-জানা পথে। যেহেতু শুক্রবার ঢাকা পাড়ি দেয়া খুব দেরী হচ্ছিল না। অচেনা ঢাকাকে দেখলাম-নিরিবিলি-গাড়ী ঘোড়া নেই-দু’একটা গাড়ী ঘোড়া যা থাকে-মানুষ জন একেবারেই নেই। খুব দ্রুত লয়ে এগিয়ে চললাম।
ছুটে চলেছি এই রাজধানীর কোলাহল থেকে দূরে-বহুদূরে প্রথমে ৩০০ ফিটে মহাসড়কের রাস্তা পেরিয়ে ডুপ্লেক্সে সিটির পাশ কাটিয়ে চলতে লাগলাম-যত সময় যাচ্ছে ততই হাতছানি দিয়ে ডাকছে “নিনগাও নরসিংদী”-অত:পর প্রায় ০১.৩০ ঘটিকায় উপস্থিত হলাম নিনগাঁও।
মহাসড়ক পাশ কাটিয়ে শুরু হল নিনগাঁও-নামটির সাথে জড়িয়ে আছে মমতা ভালোবাসা। খুব খেয়াল করলে দেখা যায় এই নামটি “গাও” সম্পৃক্ত হওয়াতে সত্যি মনে হয় সুদূর হতেও সবুজ, খালবিল ঘেরা ঘন বাসাবাড়ি সম্বলিত একটি এলাকা-সত্যি আমি মুগ্ধ-মুগ্ধতার রেশ কাটতেই এসে পড়লাম- আমাদের দুলাভাই অর্থাৎ বিথির পতিদেব সিদ্দিক ভাই এর কাছে শুনলমা নরসিংদী তথা নিনগাও এর ইতিহাস যা পনেরশ শতাব্দির দিকে রাজা নরসিংহ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। এটি বস্ত্র শিল্প, আখ, কলা ও লটকন এর জন্য বিখ্যাত বলে জানা যায়।
চলতে চলতে আমরা পৌছে গেলাম গন্তব্যে আহ কি অনাবিল আনন্দ সাথে সাথে ভেবে নিলাম জীবনে যাই করি না কেন; কাল হতে “আমি হব সকাল বেলার পাখী সবার আগে……”
এক মুহূর্তে নষ্ট করতে আমি নারাজ। একটু ফ্রেশ হয়ে ই নাস্তা করলাম-গ্রামের হাটের পরটা, ভাজি, ডাল- তৃপ্ততার ঢেকুর তুলে শুধু ভাবছি কখন দৌড় মারব- গ্রামের এই মেঠো পথ দিয়ে।
গাড়ি থামিয়ে একটা ছোট ব্রীজ পায়ে হেটে যার নিচ দিয়ে বয়ে চলেছে
ছোট খাল, তার মাঝে ডিঙ্গি নৌকা- আমি তো ভেবেই নিলাম যেমন করে হোক এই ডিঙ্গি নৌকাতে চড়তে হবে।
দূর থেকে নজর কাড়া একটি বাড়ী দেখলাম বন্ধু সেই বাড়ীর সামনে নিয়ে এল এটাই “মনের বাড়ী” অদ্ভুত স্থাপত্য শৈলীর রঙে রাঙানো “মনের বাড়ী” নজর কাড়া- সবুজের সমারোহের মধ্যে লাল ইটের আর সাদার মেলবন্ধন… এক কথায় দারুন।
ডুপ্লেক্স বাড়ীর প্রতিটি স্থানে আধুনিকতার ছোঁয়া।
মজার কান্ড হল- একটু পরেই বাড়ী ভর্তি হলে গেল গ্রামের মানুষে। সহজ-সরল মানুষগুলোর হয়তো অনেক চাওয়া নেই কিন্তু আমরা যারা নিনগাওয়ের অতিথি তাদের এক নজর মনভরে দেখাই একমাত্র চাওয়া। কিছুই পারিনি দিতে শুধু কয়েকটি ছবি ক্যামেরান্দী করলাম তাদের নিয়ে।
নাস্তাপদ শেষ করে বন্ধু আমার মাছ ধরার আয়োজনে শরীক করার তাগিদ দিল- যা হোক চাঁদের গাড়ীতে সপরিবারে এলাম পুকুর পাড়। আর পুরো রাস্তাধরে উৎসুক পল্লীবাসী আর সবুজের সৌন্দর্য্যের মাঝে নিজেকে ভাসিয়ে দিলাম।
“Fishing is a game” – সত্যি অদ্ভূত।
বাচ্চারা-আর ওদের বাবা মিলে ৫-৬টা বড় পুঁটি ও তেলাপিয়া মাছ ধরা হলো। এর পর যা হয় টাটকা ভেজে খাওয়া “আহ কি আনন্দ আকাশে-বাতাসে!!!”
মাছ ধরার পর্ব শেষ এবার যাত্রা শুরু “মনের বাড়ীর” উদ্দেশ্যে।
দুপুরের খাদ্য গলধঃকরণ সেই মাছ ভাজা, টাটকা শাক-সবজী, মাংস, কুচো চিংড়ী দিয়ে সবজী এবং নানান পদের ভর্তা- এই না হলে বলা হয় “ভোজনেই আসল তৃপ্তি।”
সবচেয়ে মজার বিষয় হল রান্নাঘর “মনের বাড়ীর” হেসেল বলতে দু’জন খালা যারা সার্বক্ষনিক তত্ত্বাবধানে আছেন রান্নার সাথে। আমি ও আমার বন্ধুও কিছুক্ষন নাড়া-চাড়ার লোভ সামলাতে পারলাম না। ঠিক ছোট্টবেলায় নানী- দাদী বাড়ীর হেসেলে-যেখানে শৈশবের অনেকটা সময় কাটিয়েছি দাদীর সাথে নানীর সাথে- সে কি ভোলা যায়!!!
আবার ফিরে গেছি শৈশবে। “মনের বাড়ী’র পূর্বদিকে তাকালে অবারিত অসীম সবুজ আর সবুজ বিধাতার এমন সৃষ্টি, এত সৌন্দর্য্য- এত মোহনীয়তা আমি ভেসে যেতে চাই, মিশে যেতে চাই- চলে যেতে চাই প্রকৃতির মাঝে বারবার।
বিকেলে সূর্য্য বেলা গড়িয়ে পড়তেই, বের হলাম পদব্রজে-আমরা সকলে। সেখানে হাতে করা গরম রসগোল্লা আর জিলাপি ভক্ষন করলাম। সন্ধ্যা হয়ে এল-গ্রামে পথে হাঁটতে হাঁটতে পাশে ঝোপের মাঝে দেখতে পেলাম জোনাকীর উড়ে যাওয়া। হাজার হাজার “জোনাকী”-তারা আলো মেখে আমাদের নিয়ে যাচ্ছে সামনে-আহা জোনাক জ্বলা রাত-কতকাল তোমায় দেখিনি। মনে পড়ে গেলো সেই শৈশবের বুলি-
“জোনাকী-জোনাকী হাতে যায় গোনা কী?
ঘুটঘুটে আঁধারে, বনে আর বাঁদারে
খুঁজে পাস সোনাকী ?
আহা জীবন-অন্ধকারে হীরের আলোর ঝলকানি- জোনকীর মাঝে। এই হলে আমার জোনাকীময় রাতের কাব্য গাঁথা।
কুয়াশা মাখা ভোরে-জেগে ওঠা কি দারুন প্রকৃতি-হেটে হেটে গ্রাম দেখা- দুপুরে বিশ্রামহীন- এবার যাত্রা শুরু হল নিনগাও পরিভ্রমন-সাথে বন্ধু বিথী ও তার পরিবার এবং আমরা। বিভিন্ন প্রকল্প ও এখানে ওখানে পরিভ্রমণ, একইসাথে গ্রামের বিভিন্ন উন্নয়ন মূলক প্রকল্প দেখা। একটি গ্রাম অথচ উন্নয়নের ছোয়া চারিদিকে-মৎস্য প্রকল্প, মুরগী প্রকল্প অথবা সবজী/ফল প্রকল্প- সাফল্য…. ছোয়ার অদ্ভুত প্রচেষ্টা।
নিনগাও মূলত পাহাড়ী এলাকা যার মাটি লাল-খুব ভালো লেগেছে সেই লাল মাটির অসংখ্য ঘর যাতে আবার আল্পনা আঁকা। ভালোবাসার আল্পনার ছোয়া মাটির ঘরে রঙীন স্বপ্নে আঁকা দারুন প্রতিচ্ছবি। হেঁটে হেঁটে এবাড়ী- ওবাড়ী দেখে আসলাম। কি আপন প্রকৃতি-কাছের মানুষ সকলে।
শহর হতে দূরে-প্রকৃতির অনেক কাছে সবুজের কোলে-
রঙীন জগতে সত্যি চিন্তা করলে এখনো মনে হয়- স্বপনের মাঝে সত্যি একটি দিন-একটি রাত
অনেক আপন সময়-ভালোবাসার বাঁধন মোড়ানো।
ধন্যবাদ বন্ধু এত্তো সুন্দর আয়োজনের জন্য।
সবুজে-সুনীল মাখামাখি আতিথেয়তায় পরিপূর্ণ বেলা নিনগাঁও মনের বাড়ী মনের কোটরে আটকে থাক আজীবন……..।
স্থপতি মোমেনুন্নেসা (আলফা)
বি, আর্ক (বুয়েট), এমএসইএস
এমআইএবি,বাপা
মোবাঃ ০১৭১২১৭৬২৯৯
০১৭৬০৯৪৮৩১৮
ইমেইলঃ momenunnesa@yahoo.com