নতুন করে ব্যবসা শুরুর পথ সহজ করতে যৌথ মূলধন কোম্পানি ও ফার্মসমূহের পরিদপ্তর (আরজেএসসি) অনলাইন নিবন্ধন প্রক্রিয়া চালু করছে। এর মাধ্যমে এক সপ্তাহের মধ্যেই কোম্পানি নিবন্ধন করা সম্ভব হতে পারে।
নিবন্ধক কর্তৃপক্ষটি আগামী জুলাই থেকে তাদের অনলাইন অনুমোদন প্রক্রিয়া চালু করবে। তখন নিবন্ধনের জন্য আবেদন করা থেকে শুরু করে এজন্য যথাযথ কাগজপত্র জমা দেওয়াসহ — দরকারি সব ধরনের আনুষ্ঠানিকতা অনলাইনেই সম্পন্ন করতে পারবেন আগ্রহী উদ্যোক্তারা।
আরজেএসসি’র রেজিস্ট্রার মিজানুর রহমান (অতিরিক্ত সচিব) বলেন, অটোমেশন (স্বয়ংক্রিয়) পদ্ধতি চালুর পরে, অনলাইনে যথাযথভাবে কাগজপত্র জমা দেওয়া হলে– অনুমোদন প্রক্রিয়া সম্পন্ন হতে এক সপ্তাহের বেশি লাগবে না।
বিশ্বব্যাংকের সর্বশেষ ২০২০ সালের বৈশ্বিক ইজ অব ডুয়িং বিজনেস বা সহজে ব্যবসার র্যাঙ্কিংয়ে ১৯০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১৬৮ তম।
মোটা দাগে ১০টি ভিত্তির ওপরে বিশ্বব্যাংক ডুয়িং বিজনেসের র্যাঙ্কিং করে। এগুলো হলো ব্যবসা শুরুর অনুমোদন, ভবন নির্মাণের অনুমতি, বিদ্যুৎ–সংযোগ, সম্পত্তি নিবন্ধন, ঋণপ্রাপ্তি, ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের সুরক্ষা, কর প্রদান, বৈদেশিক বাণিজ্য, চুক্তির বাস্তবায়ন ও দেউলিয়া ঘোষণার প্রক্রিয়া।
ব্যবসা শুরুর দিক থেকে ১৯০টি দেশের মধ্যে ১৩১তম অবস্থানে বাংলাদেশ।
বিশ্বব্যাংক জানায়, দুর্নীতি, স্বচ্ছতার অভাব, ফাইল অনুমোদনে অতি ধীরগতির ঘটনা সহজে ব্যবসার সূচকে বাংলাদেশের আরও ভালো স্কোর অর্জনকে ব্যাহত করছে।
বাংলাদেশের বিপুল সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও- সে তুলনায় প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই) কম আসার জন্য ব্যবসা শুরু বা অনুমোদনের ধীরগতিকেই অন্যতম প্রধান কারণ বলে উল্লেখ করেন বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিডা) নির্বাহী চেয়ারম্যান লোকমান হোসেন মিয়া।
গতবছরের ফেব্রুয়ারিতে ব্যবসায়ীদের সামনে এনিয়ে হতাশা ব্যক্ত করে তিনি বলেন, “ভিয়েতনামে (অনুমোদন সংক্রান্ত) সব ধরনের সেবা পেতে মাত্র ৩৫ দিন লাগে, ইন্দোনেশিয়ায় ৪৯ দিন, আর ভারতে লাগে ৬০ দিন। কিন্তু, বাংলাদেশে লেগে যায় ৬ মাস।”
দীর্ঘসুত্রিতার পাশাপাশি– নির্ধারিত নিবন্ধন ফির বাইরে প্রায়ই বাড়তি অর্থ খরচ করতে হয় উদ্যোক্তাদের। অনুমোদন প্রক্রিয়া চলাকালীন তাঁরা নানান রকমের হয়রানি ও বিড়ম্বনার শিকার হন বলেও জানান অংশীজনরা।
এই প্রেক্ষাপটে, অনুমোদন প্রক্রিয়া সহজ করা এবং সময় কমিয়ে আনার সাথেসাথে ব্যবসা নিবন্ধনের সময় হয়রানি রোধ করতে চায় বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অধীনস্ত আরজেএসসি। এজন্য আগামী জুলাই মাস থেকে পাবলিক-প্রাইভেট কোম্পানি, একক ব্যক্তি কোম্পানি (ওপিসি) এবং পার্টনারশিপ ফার্মের নিবন্ধনের সকল আবেদন প্রক্রিয়ায়– অটোমেশন পদ্ধতি চালু করতে যাচ্ছে।
আরজেএসসি’র কর্মকর্তারা বলছেন, এটি বাস্তবায়িত হলে– কোম্পানি নিবন্ধন, নবায়ন, আয়কর রিটার্ন দাখিল, মালিকানা পরিবর্তন ও অবসায়নসহ সকল রকমের প্রক্রিয় ঘরে বসেই সম্পন্ন করা যাবে। দেশ-বিদেশে যেকোনো জায়গায় বসে এসব প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে পারবেন তাঁরা।
মিজানুর রহমান বলেন, “ইউএসএইড (USAID) এর অর্থায়নে অটোমেশন প্রকল্পের কাজ দুই বছর ধরে চলছে, যা এখন প্রায় শেষ দিকে। খুব শিগগিরই এর একটি পাইলট কার্যক্রম শুরু করা হবে। বাণিজ্যমন্ত্রী এই কার্যক্রমের উদ্বোধন করবেন। দুই থেকে চার মাস ব্যাপী পাইলট কার্যক্রম চলার পরে জুলাই মাস থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে কার্যক্রম শুরু হবে।”
অনলাইন প্রক্রিয়া যেভাবে কাজ করবে
আরজেএসসির একজন কর্মকর্তা জানান, একটি কোম্পানি নিবন্ধিত হওয়ার পরে, সেটির অনুমোদনের একটি প্রত্যয়িত কপি স্বয়ংক্রিয়ভাবে আবেদনকারীর ইমেলে চলে যাবে। এছাড়াও, বাংলাদেশ ব্যাংক, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডসহ সরকারের অন্যান্য দপ্তর/ সংস্থার দ্বারা এই কোম্পানির অনুমোদন সংক্রান্ত যাবতীয় তথ্য আরজেএসসি থেকে পাঠানো হবে।
ওই কর্মকর্তা আরও জানান, অনুমোদিত কোম্পানির মূলধনসহ সমস্ত তথ্য সম্বলিত একটি ডেটাবেজ আরজেএসসির কাছে থাকবে, সেখানে প্রতিষ্ঠানটির আয়কর রিটার্নের তথ্য যোগ করা হবে। ওই কোম্পানির নামে কেউ ঋণের আবেদন করলে– ব্যাংক বা আর্থিক সংস্থা কোম্পানির সম্পর্কে যাবতীয় তথ্য আরজেএসসির থেকে নিতে পারবে। এজন্য একটি ডিজিটাল প্রক্রিয়া চালু করা হবে।
কোম্পানি নিবন্ধনের সাম্প্রতিক সময়ের পরিস্থিতি
কর্মকর্তারা বলছেন, করোনা মহামারি, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ এবং রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বাংলাদেশে নতুন কোম্পানি নিবন্ধনের সংখ্যা অনেকটাই কমেছে। নিবন্ধন কমার সাথেসাথে বিনিয়োগের পরিমাণও উল্লেখযোগ্য হারে হ্রাস পেয়েছে।
২০২৩-২০২৪ অর্থবছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত ৪ হাজার ৫১৬টি নতুন কোম্পানি নিবন্ধন নিয়েছে, ২০২২-২০২৩ অর্থবছরে নিয়েছে ৮ হাজার ১৬১টি এবং ২০২১-২২ অর্থবছরে ১৩ হাজার ২১৮টি কোম্পানি নিবন্ধন নেয়।
আরজেএসসির তথ্যমতে, বর্তমানে দেশে মোট নিবন্ধিত ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ২ লাখ ৮৮ হাজার।
উদ্যোক্তাদের নতুন বিনিয়োগে উৎসাহিত করতে আরজেএসসি ইতোমধ্যে একটি উদ্যোগ বাস্তবায়ন করেছে। যার আওতায়, ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের পাবলিক বা প্রাইভেট কোম্পানিতে ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত বিনিয়োগের জন্য নিবন্ধন ফি অব্যাহতি দেওয়া হয়।
এছাড়াও আগে নতুন কোম্পানি নিবন্ধনের জন্য আগে আরজেএসসি’র অফিসে এসে পরিচালক বা শেয়ারহোল্ডারদের নতুন কোম্পানির আবেদনপত্রসহ বিভিন্ন কাগজে সই করতে হতো। তবে সাম্প্রতিক সময়ে সেটি বাতিল করে ইলেকট্রনিক ডিভাইসের মাধ্যমে অনলাইনে স্বাক্ষর প্রদানের অনুমতি দেওয়া হয়েছে।
পাশাপাশি বিডার ওয়ান স্টপ সার্ভিস সেন্টারের মাধ্যমে নতুন কোম্পানির অনুমোদন নিতে আবেদন প্রক্রিয়া সম্পন্ন করার সুবিধা তৈরি করেছে আরজেএসসি।
আগে একটি কোম্পানি নিবন্ধন করার পরে, সংশ্লিষ্টদের কোম্পানির মূল সনদ পেতে বারবার আরজেএসসি অফিসে যেতে হতো। তবে কর্তৃপক্ষটি এখন নামমাত্র ফি দিয়ে এই সার্টিফিকেটগুলো দ্রুত ইস্যু করার জন্য একটি অনলাইন ব্যবস্থা চালু করেছে।
ডিজিটাল পদ্ধতিতে কোম্পানি নিবন্ধনের জন্য ২০১১ সালে প্রথম উদ্যোগ নেয় আরজেএসসি। শুরুতে শুধু কোম্পানির নামের ক্লিয়ারেন্স নিত এই পদ্ধতিতে। এরপর আরও কয়েকটি প্রক্রিয়া চালু করলেও সেগুলোর কার্যকরীতা ছিল সীমিত।
আরজেএসসি’র রেজিস্ট্রার মিজানুর রহমান টিবিএসকে বলেন, অনলাইনে পরিচালনা করার উদ্দেশ্যে কিছু প্রক্রিয়া এরমধ্যেই করা হলেও– অনেক উদ্যোক্তার মধ্যে সচেতনতার অভাবেই সেগুলোর পুরোপুরি বাস্তবায়ন সম্ভব হচ্ছে না।
এদিকে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, নতুন কোম্পানি শুরু করতে দীর্ঘসময় লেগে যায়। তাই সহজে ব্যবসা পরিচালনার জন্য উদ্যোক্তাদের মধ্যে বিদ্যমান কোম্পানিগুলোকে অধিগ্রহণের প্রবণতা রয়েছে।
সিঅ্যান্ডএ টেক্সটাইলকে অধিগ্রহণ করা আলিফ গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. আজিমুল ইসলাম বলেন, “এই কোম্পানিটি অধিগ্রহণ করে আমরা খুব কম সময়ে ব্যবসা শুরু করতে পেরেছি, কিন্তু নতুন করে ব্যবসা শুরু করতে গেলে কমপক্ষে তিন বছর লাগতো।”
বাংলাদেশ-চায়না চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির মহাসচিব আল মামুন মৃধা বলেন, ভূরাজনৈতিক অস্থিরতা, বাংলাদেশের চলমান অর্থনৈতিক সংকট ও রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার কারণে নতুন কোম্পানি নিবন্ধন কমছে।
তিনি বলেন, “এসব কারণে নতুন কোম্পানি চালুর ট্রেন্ড কমেছে। আরজেএসসির সাম্প্রতিক পদক্ষেপ উদ্যোক্তাদের নতুন বিনিয়োগে উৎসাহিত করবে বলে আশা করছি।”
কোম্পানি আইন বিশেষজ্ঞ ব্যারিস্টার তানজীব -উল- আলম বলেন, উন্নত দেশগুলোতে একটি কোম্পানি শুরু করার জন্য ঘরে বসেই সব প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা সম্ভব। “কিন্তু বাংলাদেশে অনেকদিন ধরেই এই সহজীকরণ প্রক্রিয়া চালু করার কথা বলা হলেও সেটি হয়নি। আরজেএসসির কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বাধার কারণেই এটি করা যায়নি।”
বাংলাদেশের আইন অনুযায়ী, কোম্পানি গঠন থেকে শুরু করে মালিকানা সংক্রান্ত সমস্ত তথ্য সংরক্ষণের একমাত্র কর্তৃপক্ষ– যৌথ মূলধন কোম্পানি ও ফার্মসমূহের পরিদপ্তর (আরজেএসসি)।
বর্তমানে প্রাইভেট ও পাবলিক কোম্পানির প্রস্তাবিত প্রতিটি নামের জন্য ৫০০ টাকা, অংশীদারি ব্যবসার প্রস্তাবিত প্রতিটি নামের জন্য ৫০০ টাকা, সমিতি (সোসাইটি)-প্রস্তাবিত প্রতিটি নামের জন্য ২,০০০ টাকা এবং পেশাদার সংগঠন- প্রস্তাবিত প্রতিটি নাম নিবন্ধনের জন্য ৫০০ টাকা জমা দিতে হয়।
আর বিনিয়োগ করা মূলধনের ওপর ৪০ লাখ টাকা পর্যন্ত ফি দিতে হয় ২০ হাজার টাকা।