যেকোনো জায়গা চিনতে আমরা হরহামেশা গুগলের মানচিত্র বা ম্যাপ ব্যবহার করি। তবে অনেক সময় গুগল ম্যাপে চাহিদা অনুসারে পর্যাপ্ত তথ্য পাওয়া যায় না। আবার বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে গুগল ম্যাপ ব্যবহারের খরচও অনেক বেশি। এ সমস্যার সমাধান এনেছে ‘বাড়িকই’ নামের দেশীয় একটি স্টার্টআপ।
গ্রাহকের চাহিদা অনুসারে বাণিজ্যিকভাবে ম্যাপসেবা দেয় ‘বাড়িকই’। যেকোনো বাসা, দোকান বা প্রতিষ্ঠানের হোল্ডিং ঠিকানা, লাইভ লোকেশন, প্রতিষ্ঠানের ধরন প্রভৃতি তথ্য সরবরাহ করে তারা। আর এ সেবা নেয় ই–কমার্স প্ল্যাটফর্ম, সরবরাহ খাত, ব্যাংকসহ সরকারি–বেসরকারি ৬০টির বেশি প্রতিষ্ঠান। ম্যাপসেবা দিয়ে স্টার্টআপটি বছরে প্রায় আড়াই কোটি টাকা আয় করছে।
‘বাড়িকই’–এর দুই সহপ্রতিষ্ঠাতা হলেন মো. আল আমিন সরকার ও সাদমান সাকিব। দুজনেই নর্থ-সাউথ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কম্পিউটার সায়েন্সে পড়াশোনা করেছেন। নিজেদের কাজ সম্পর্কে আল আমিন বলেন, যেকোনো সেবা প্রদানের জন্য গ্রাহকের সঠিক ঠিকানা জানা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সঠিক মানচিত্র জানা থাকলে হাজারো পরিষেবা সহজে দেওয়া যায়। এতে সময় বা অর্থ খরচ—দুটিই বাঁচে।
শুরুটা যেভাবে
২০১৫ সালে স্নাতক পর্ব শেষ করেন আল আমিন ও সাদমান সাকিব। এ সময় ‘আমার বাইক’ নামে একটি রাইড শেয়ারিং স্টার্টআপ দেশে কার্যক্রম শুরু করে। এই প্রতিষ্ঠানের জন্য অ্যাপ তৈরি ও অন্যান্য প্রযুক্তিগত কাজ করতেন তাঁরা। তহবিল সংকটে কয়েক মাসের মধ্যে প্রতিষ্ঠানটির কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়। তবে প্রতিষ্ঠানটিতে কাজ করতে গিয়ে ম্যাপ বা মানচিত্র সম্পর্কে ধারণা তৈরি হয় দুই বন্ধুর।
আল আমিন জানান, রাইড শেয়ারিংয়ের ক্ষেত্রে বেশির ভাগ সময় মানুষ সঠিক ঠিকানার পরিবর্তে এলাকাভিত্তিক নির্দেশনা দেন। অর্থাৎ, নির্দিষ্ট কোন ভবনে যাবেন, সেটা না বলে, এলাকার নাম বা সড়কের নাম বলেন। এতে ভাড়ার সঙ্গে দূরত্বের পার্থক্য হয়ে যায়। এ সমস্যা সমাধানে তখন আমরা নিজস্ব পদ্ধতিতে ম্যাপ তৈরির চিন্তা করি। ‘আমার বাইকের’ কার্যক্রম বন্ধ হলেও ম্যাপ তৈরির কাজটি চালিয়ে যান দুই বন্ধু। নিজেদের জমানো ২ লাখ টাকা পুঁজি নিয়ে শুরু হয় এই যাত্রা।
কয়েক মাস এভাবে চলে। ২০১৭ সালের শুরুতে গ্রামীণফোন (জিপি) অ্যাকসিলারেটরের চার মাসব্যাপী একটি কর্মসূচিতে ডাক পান তাঁরা। সাদমান সাকিব বলেন, ‘আমরা ম্যাপ তৈরির কাজ তো করছিলাম, তবে এর বাণিজ্যিক সম্ভাবনা নিয়ে স্পষ্ট ধারণা ছিল না। জিপি অ্যাকসিলারেটরের কর্মসূচিতে গিয়ে এ বিষয়ে বুঝতে পারি।’
ব্যবসাকে বড় করতে প্রয়োজন বড় বিনিয়োগ। তাই বিনিয়োগকারী খুঁজতে থাকেন দুই বন্ধু। ২০১৮ সালের মে মাসে একজন অ্যাঞ্জেল ইনভেস্টর থেকে ৩০ লাখ টাকা বিনিয়োগ পান তাঁরা। এর পরপরই আনুষ্ঠানিকভাবে ‘বাড়িকই’ নামে প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম শুরু হয়।
মো. আল আমিন সরকার
কাজের ধরন
একটা বাসার হোল্ডিং ঠিকানা, লাইভ লোকেশন, ওই বাসায় বাণিজ্যিক কোনো প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম থাকলে তার ঠিকানা ও প্রতিষ্ঠান–সম্পর্কিত তথ্য সংগ্রহ করেন ‘বাড়িকই’–এর কর্মীরা। বিশেষ করে রাজধানীসহ যে শহরগুলোয় আর্থিক কর্মকাণ্ডের পরিমাণ বেশি, সেখানকার বিস্তারিত তথ্য সংগ্রহ করে প্রতিষ্ঠানটি। এসব তথ্য নির্দিষ্ট সময় পরপর হালনাগাদ করা হয়। মাঠপর্যায় থেকে পাওয়া তথ্য একাধিকবার যাচাই করে তা ম্যাপের মধ্যে যুক্ত করা হয়। একটি প্রতিষ্ঠান, ভবন বা জায়গা একাধিক নামে পরিচিত হতে পারে। এ জন্য ম্যাপের সার্চ অপশনে সম্ভাব্য সব ধরনের নাম যুক্ত করে দেওয়া হয়।
প্রথম দুই বছরে তথ্য সংগ্রহের মাধ্যমে ডেটা সেট এবং অ্যাপ্লিকেশন প্রোগ্রামিং ইন্টারফেস বা এপিআই তৈরি করে বাড়ি কই। এরপর রাজধানী ঢাকার সব অলিগলি পর্যন্ত তথ্য সংগ্রহ করা হয়। পাশাপাশি বিভিন্ন সিটি করপোরেশন, জেলা শহর ও গ্রামের বাজার পর্যন্ত তথ্য নিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি।
আল আমিন জানান, সারা দেশের ৯০ শতাংশ দোকানের অবস্থান ও ধরন–সম্পর্কিত তথ্য রয়েছে তাদের কাছে। এ ছাড়া কৃষি খাতে কোন ধরনের খামার কোথায় রয়েছে, কোথায় কোথায় সৌর প্যানেল রয়েছে—এমন বিভিন্ন ধরনের বৈচিত্র্যপূর্ণ তথ্যও সংগ্রহ করেছেন তাঁরা।
গ্রাহক যারা
প্রতিষ্ঠার পর প্রতিষ্ঠানটি প্রথম গ্রাহক পায় ২০১৯ সালের অক্টোবরে। ল্যান্ড নক নামে একটি ডেলিভারি সফটওয়্যার পরিষেবা প্রতিষ্ঠান মাসিক ৫ হাজার টাকা সাবস্ক্রিপশনে বাড়ি কই–এর সেবা নেয়। আর ওই বছরের শেষে সার্ভিস প্ল্যাটফর্ম ‘সেবা এক্সওয়াইজেড’ কে গ্রাহক হিসেবে
পান তাঁরা।
আল-আমিন জানান, ২০২০ সালে করোনা মহামারি শুরু হলে দেশে ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলোর কার্যক্রম অনেক বৃদ্ধি পায়। তখন অনেক প্রতিষ্ঠান গুগলের ম্যাপ–সুবিধা ব্যবহার করত। তবে এর খরচ অনেক বেশি এবং বিল পরিশোধ করতে হয় ডলারে। এমন পরিস্থিতিতে আমাদের ম্যাপের চাহিদা বাড়তে থাকে। ওই বছর ই–কমার্স প্রতিষ্ঠান চালডাল ডটকমসহ বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হই। পরবর্তী তিন বছরে যুক্ত হয় ইউনিলিভার, জেটিআই, গো–জায়ান, হাংরি নাকি, ট্রাক লাগবে, রকমারি ডটকম, ওভাই, রেড এক্স, স্টিডফাস্ট, পিকাবোসহ বেশ কিছু প্রতিষ্ঠান।
প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম আরও বাড়াতে খাতভিত্তিক ও প্যাকেজ আকারে বিভিন্ন সেবা দেওয়ার পরিকল্পনা করেন তাঁরা। প্রথমেই ব্যাংক খাত দিয়ে শুরু করেন তাঁরা। ব্যাংকের ঋণ কিংবা ক্রেডিট কার্ড প্রদানের আগে গ্রাহকের তথ্য যাচাই করা হয়। এ ক্ষেত্রে সেবা দেয় ‘বাড়িকই’। ২০২১ সালে বেসরকারি সিটি ব্যাংকের সঙ্গে প্রথমে তাঁরা কাজ শুরু করেন। বর্তমানে আটটি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান তাদের গ্রাহক।
সরকারি কিছু প্রতিষ্ঠানের সঙ্গেও কাজ করেছে ‘বাড়িকই’। ২০২২ সালে একটি সিটি করপোরেশনের জন্য রেভিনিউ ভিজুয়ালাইজেশন পদ্ধতি তৈরি করে দেয় প্রতিষ্ঠানটি। এর ফলে গৃহকর বাবদ কোন এলাকা থেকে কী পরিমাণ আয় আসছে বা রাজস্ব হারাচ্ছে, তা সহজেই বোঝা যায়। এভাবে বিদ্যুৎ ও টোলিেযাগােযাগ খাতের
একাধিক সরকারি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে তাদের কাজ রয়েছে।
বাড়িকই–এর সহপ্রতিষ্ঠাতা সাদমান সাকিব বলেন, ‘আমাদের কাছে বিপুল তথ্য রয়েছে। সরকারি বিভিন্ন পরিষেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান যেমন, ফায়ার ব্রিগেড, পুলিশ, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড, বিটিআরসিসহ স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলো আমাদের থেকে সেবা নিতে পারেন। অন্যদিকে ভোগ্যপণ্য থেকে শুরু করে যেকোনো বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানও এ সেবা নিতে পারবে।’
বর্তমান অবস্থা
মাত্র ২ লাখ টাকা পুঁজি নিয়ে শুরু করা স্টার্টআপটি এখন পর্যন্ত ৫ কোটি টাকা বিনিয়োগ তুলতে পেরেছে। এর মধ্যে বিদেশি বিনিয়োগও রয়েছে। প্রতিষ্ঠানটির উদ্যোক্তারা জানান, বর্তমানে বছরে আড়াই কোটি টাকা আয় হচ্ছে তাঁদের। আর প্রতিষ্ঠানটিতে নিয়মিত কাজ করছেন ৮৫ জন কর্মী।
নিজেদের লক্ষ্য সম্পর্কে সাদমান সাকিব বলেন, ‘বাসাবাড়ি ও প্রতিষ্ঠানের অবস্থানগত তথ্য সংগ্রহ করে আমরা একটি সমৃদ্ধ তথ্যভান্ডার গড়ে তুলছি। এর মাধ্যমে গ্রাহক প্রতিষ্ঠানগুলোকে চাহিদামতো সুবিধা দিতে পারছি, বৈদেশিক মুদ্রাও সাশ্রয় করছি। সবচেয়ে বড় কথা ম্যাপনির্ভর তথ্যে দেশের স্বনির্ভরতা বাড়াতে পারছি।’
দেশের বাইরেও কার্যক্রম বিস্তৃতের পরিকল্পনা করেছে বাড়ি কই। ইতিমধ্যে স্টার্টআপটি প্রতিবেশী দেশ নেপাল ও শ্রীলঙ্কায় স্বল্প পরিসরে কার্যক্রম শুরু করেছে। প্রতিষ্ঠানটির সহপ্রতিষ্ঠাতা আল আমিন বলেন, ‘এশিয়া ও আফ্রিকায় অর্থনৈতিকভাবে আমাদের সমপর্যায়ের দেশগুলোয় ম্যাপ পরিষেবা দিতে চাই আমরা। এ জন্য বড় বিনিয়োগ প্রয়োজন। সেই বিনিয়োগ পেলে দেশের বাইরে আমাদের কর্মকাণ্ড সম্প্রসারিত করব।’