ছাত্র-জনতা অভ্যুত্থানের সময় গত ১৭ জুলাই রাত থেকে মোবাইল ইন্টারনেট এবং ১৮ জুলাই রাতে ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট বন্ধ করে দেয় তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার। পাঁচ দিনের মাথায় ২৩ জুলাই ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট সংযোগ সীমিত পরিসরে চালু করা হয়। আর ১০ দিন পর ২৮ জুলাই মোবাইল ইন্টারনেট চালু হয়। খাজা টাওয়ারে আগুন নাটক সাজিয়ে সরকারের টেলিকম-আইএসপিএবি’র যোগসাজশে ৫ দিনের ইন্টারনেট ব্লাকআউটে ডিজিটাল লেনদেন সেবাও কার্যত বন্ধ হয়ে যায়।
এতে অচল হয়ে পড়ে রাজধানীসহ দেশের অধিকাংশ এলাকার এটিএম বুথ। ব্যাপক হারে কমে যায় ক্রেডিট কার্ডের লেনদেনও। ফলে জুলাই মাসে এটিএম, পস, সিএআরএম ও ই-কমার্সে প্রায় ৫০ হাজার কোটি টাকা এবং এটিএম কার্ডে ২১ শতাংশ লেনদেন কমেছিলো। এ ছাড়াও লেনদেনের সংখ্যা কমেছে ১৮ শতাংশের বেশি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ হালনাগাদ প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, চলতি বছরের জুলাই মাসে এটিএম, পস, সিএআরএম ও ই-কমার্সে লেনদেন হয়েছে ৪০ হাজার ৮৩৯ কোটি টাকা। যা তার আগের মাস জুনে ছিল ৫১ হাজার ৬৫২ কোটি টাকা। সে হিসেবে লেনদেন কম হয়েছে ১০ হাজার ৮১২ কোটি টাকা বা ২১ শতাংশ। এছাড়াও জুলাই মাসে ট্রানজেকশন হয়েছে ৪ কোটি ৩২ লাখ ১৩ হাজার টি, যেখানে আগের মাসে হয়েছিল ৫ কোটি ২৯ লাখ ৫৩ হাজার টি। লেনদেন কমেছে প্রায় ৯৭ লাখ ২৪ হাজার টি।
প্রতিবেদন বলছে, জুলাই মাসে এটিএম বুথে লেনদেন হয়েছে ২৩ হাজার ৭৩৬ কোটি টাকা। জুন মাসে লেনদেন হয়েছিল ৩১ হাজার ১৩৭ কোটি টাকা। লেনদেন কমেছে ৭ হাজার ৪৯১ কোটি টাকা। এছাড়াও গত জুলাই মাসে বিভিন্ন দোকান, বিপনি বিতানে পস মেশিনের মাধ্যমে লেনদেন হয়েছে ২ হাজার ৭১৩ কোটি টাকা। তার আগের মাস জুনে লেনদেন হয়েছিল ৩ হাজার ১৯৯ কোটি টাকা। সে হিসেবে লেনদেন কম হয়েছে প্রায় ৪৮৫ কোটি টাকা। জুলাই মাসে লেনদেনে ভাটা পড়ে ই-কমার্সেও। কারণ ই-কমার্স খাত পুরোপুরি ইন্টারনেটের ওপর নির্ভশীল। আর ওই মাসে বেশ কয়েকদিন বন্ধ থাকে ইন্টারনেট। ওই মাসে ই-কমার্স খাতে লেনদেন হয় ১ হাজার ৪৪৮ কোটি টাকা। তার আগের মাসে হয়েছিল ১ হাজার ৬৮৮ কোটি টাকা। লেনদেন কম হয়েছে ২৪০ কোটি টাকা।
এদিকে জুলাই মাসের আন্দোলন ও ইন্টারনেট বন্ধ থাকায় ব্যাপক পতন হয়েছে ক্রেডিট কার্ড লেনদেনেও। দেশে বিদেশে সবখানেই কমেছে ক্রেডিট কার্ড লেনদেন। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদন বলছে, গত জুলাই মাসে দেশের অভ্যন্তরে ক্রেডিট কার্ডে লেনদেন হয়েছে ২ হাজার ৩৪২ কোটি টাকা, যা জুন মাসে ছিল ২ হাজার ৭১৫ কোটি টাকা। অর্থাৎ ক্রেডিট কার্ডে দেশের অভ্যন্তরে লেনদেন কমেছে ৩৭৩ কোটি টাকা বা ১৪ শতাংশ। এসময় দেশের অভ্যন্তরে বিদেশিরা খরচ করেছেন ১৩৬ কোটি টাকা। যা জুন মাসে ছিল ১৭৬ কোটি টাকা। খরচ কমেছে প্রায় ৪০ কোটি টাকা।
একই সময়ে দেশের অভ্যন্তরে ক্রেডিট কার্ডে লেনদেনের মাধ্যমে ডিপার্টমেন্টাল স্টোরে খরচ হয়েছে ১ হাজার ১৯৬ কোটি, খুচরা দোকানে ৩১৮ কোটি, ইউটিলিটি বাবদ ২০৮ কোটি, নগদ উত্তোলন ১৭১ কোটি, কাপড় কেনায় ৮৯ কোটি, ফার্মেসিতে ১৪০ কোটি, ফান্ড স্থানান্তর ৭৬ কোটি, পরিবহনে ৭০ কোটি, বিজনেস সার্ভিস ৪২ কোটি, প্রফেশনাল সার্ভিস ১৮ কোটি ও সরকারি সেবায় ১০ কোটি টাকা। গত জুন মাসে যার প্রত্যেকটি সূচকে খরচ বেশি ছিল। এছাড়াও, দেশের ভেতর জুলাইয়ে ভিসা কার্ডের মাধ্যমে খরচ হয়েছে ১ হাজার ৬৯২ কোটি টাকা, মাস্টার কার্ডের মাধ্যমে ৪১৫ কোটি, অ্যামেক্সে ২৩১ কোটিসহ আরও বেশ কয়েকটি কার্ডের মাধ্যমে বাকি টাকা ব্যয় করা হয়।
প্রতি মাসেই ক্রেডিট কাডের মাধ্যমে দেশের বাইরে বিপুল পরিমাণ অর্থ খরচ করেন বাংলাদেশিরা। এর মধ্যে শীর্ষ অবস্থানে থাকে ভারত। কিন্তু জুলাই মাসে ভিন্ন চিত্র দেখা গেছে। পুরো জুলাই মাস জুড়ে বিদেশে ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার করে বাংলাদেশিরা ৪৭৫ কোটি টাকা ব্যয় করেছেন। যা জুন মাসে ছিল ৫২৪ কোটি টাকা। অর্থাৎ এক জুলাইয়ে খরচ কমেছে প্রায় ৫০ কোটি টাকা। এর মধ্যে বাংলাদেশিরা সব থেকে বেশি ৮০ কোটি টাকা যুক্তরাষ্ট্রে খরচ করেছে। ভারতে খরচ করেছে ৭৩ কোটি টাকা। অথচ তার আগের মাসে যুক্তরাষ্টে খরচ ছিল ৭৭ কোটি ও ভারতে ছিল ৯২ কোটি টাকা। এছাড়াও বাংলাদেশিরা ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার করে থাইল্যান্ডে ৫০ কোটি, যুক্তরাজ্যে ৩৯ কোটি টাকা খরচ করেছে।
অপরদিকে জুলাই মাসে দেশের ব্যাংকিং খাতে আমানত কমেছে ৮ হাজার ২০০ কোটি টাকা। অনিশ্চিত পরিস্থিতিতে হাতের কাছে নগদ অর্থ রাখতে চাওয়ায় আমানত কমার সঙ্গে সঙ্গে জুলাইয়ে মানুষের হাতে থাকা অর্থের পরিমাণও বেড়েছে প্রায় ১ হাজার ২০০ কোটি টাকা।
কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্কের তথ্য অনুসারে, জুলাইয়ে মোট আমানত কমে দাঁড়িয়েছে ১৭.৪২ লাখ কোটি টাকা, যা আগের মাসের চেয়ে ০.৪৭ শতাংশ কম। গতবছরের একই মাসের তুলনায় চলতি বছরের জুলাইয়ে আমানতের প্রবৃদ্ধি দাঁড়িয়েছে ৭.৯১ শতাংশ, যা গত ১৬ মাসের মধ্যে সর্বনিম্ন। এরচেয়ে কম ৭.৫৩ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ২০২৩ সালের মার্চে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে, জুলাই শেষে ব্যাংকের বাইরে বা মানুষের হাতে থাকা অর্থের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২.৯১ লাখ কোটি টাকা। জুনের তুলনায় এটি ১ হাজার ২০০ কোটি টাকা বেশি। গত বছরের জুলাই মাস মানুষের হাতে ২.৬৬ লাখ কোটি টাকা ছিল।