করোনার সংক্রমণ শুরু হওয়ার পর থেকে প্রতিবছরই নিত্যনতুন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ছে দেশের শীর্ষ রপ্তানি খাত তৈরি পোশাকশিল্প। এরপরও তৈরি পোশাক রপ্তানি বাড়ছে। বদৌলতে প্রতিবছর এই খাতে গড়ে ১৩৪টি নতুন কারখানা স্থাপিত হচ্ছে।
তৈরি পোশাকশিল্পের মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর তথ্য অনুযায়ী, ২০১৮ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত ছয় বছরে দেশে ৬০৩টি কারখানা সংগঠনটির অস্থায়ী সদস্যপদ নিয়েছে। এর মধ্যে স্থায়ী সদস্যপদ পেয়েছে ৫৬৫টি কারখানা (বছরে গড়ে ৯৪টি) স্থায়ী পদ পেয়েছে। এসব কারখানার মধ্যে অর্ধেকই হয়েছে গত দুই বছরে, অর্থাৎ ২০২২ ও ২০২৩ সালে।
পোশাক খাতের উদ্যোক্তারা বলেন, করোনাভাইরাসের প্রথম ঢেউয়ে একের পর এক ক্রয়াদেশ বাতিল ও স্থগিত হওয়ায় পোশাক রপ্তানি বড় ধরনের হুমকির মধ্যে পড়ে। তখন অনেক উদ্যোক্তাই নিজেদের ব্যবসা টিকিয়ে রাখা নিয়ে দুশ্চিন্তায় ছিলেন। সেই জায়গা থেকে ব্যবসা আবার ঘুরে দাঁড়িয়েছে। শুধু তা–ই নয়, নিত্যনতুন চ্যালেঞ্জের মধ্যে নতুন কারখানা গড়ে উঠেছে, যা পোশাকশিল্পের জন্য ইতিবাচক।
সংগঠনটির তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, করোনার আগের চেয়ে করোনার পরে নতুন কারখানা স্থাপনের হার বেড়েছে। করোনার আগের দুই বছর ২০১৮ ও ২০১৯ সালে যথাক্রমে ৬১টি ও ৮১টি কারখানা হয়েছে এবং করোনার বছরে (২০২০ সাল) ছিল ৫৮টি। পরের বছর থেকেই নতুন কারখানার সংখ্যা বাড়তে থাকে। ৮৬টি কারখানা হয়েছিল সে বছর। আর ২০২২ ও ২০২৩ সালে নতুন কারখানা হয়েছে যথাক্রমে ১৮২ ও ১৩৪টি।
জানতে চাইলে বিজিএমইএর সভাপতি ফারুক হাসান গতকাল বৃহস্পতিবার গত ছয় বছরের কারখানা স্থাপনের তথ্য দিয়ে বলেন, এটি শুধু একটি পরিসংখ্যান নয়। এটি শিল্প নিয়ে উদ্যোক্তাদের মনোভাবের নিদর্শনও, যা পোশাকশিল্পকে শক্তি জোগাচ্ছে। তিনি আরও বলেন, ‘গত কয়েক বছরে যেসব কারখানা আমাদের সঙ্গে যোগ দিয়েছে, তারা সবাই পোশাকশিল্পে নতুন নয়। বিদ্যমান ইউনিটগুলোর একটি অংশ ব্যবসা সম্প্রসারণ করেছে। এ ছাড়া শিল্পের বিভিন্ন পর্যায়ে কাজ করেছেন, এমন পেশাজীবীরাও উদ্যোক্তা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছেন।’
জানা গেছে, কারখানা স্থাপনের পর বিজিএমইএর সদস্যপদের জন্য ট্রেড লাইসেন্স, ভবনের নকশা, প্রয়োজনীয় কাগজপত্রসহ আবেদন করতে হয়। সেই আবেদনের পর বিজিএমইএর কর্মকর্তারা সংশ্লিষ্ট কারখানা ভবনের নিরাপত্তাসহ কমপ্লায়েন্সের বিভিন্ন বিষয়ে সরেজমিনে পরিদর্শন করে অস্থায়ী সদস্যপদ দেন। এরপর আমদানি ও রপ্তানি সনদ, বন্ড লাইসেন্সসহ বিভিন্ন সনদ পাওয়ার পরে চূড়ান্ত সদস্যপদ দেওয়া হয়।
বিজিএমইএর সহসভাপতি শহিদউল্লাহ আজিম গত রাতে বলেন, দেশে নতুন কারখানা হচ্ছে। আবার অনেক কারখানা বন্ধও হচ্ছে। এভাবেই এগিয়ে যাচ্ছে পোশাকশিল্প। তিনি জানান, বর্তমানে বিজিএমইএতে সদস্য কারখানার সংখ্যা ১ হাজার ৬০০-এর কাছাকাছি।
এদিকে পোশাক কারখানার সঙ্গে তৈরি পোশাক রপ্তানিও বাড়ছে। ছয় বছরে তৈরি পোশাক রপ্তানি প্রায় দেড় গুণ বেড়েছে। যদিও চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসের মধ্যে গত তিন মাস রপ্তানি কমেছে। তবে সার্বিকভাবে অর্থবছরের প্রথমার্ধে পোশাক রপ্তানি বেড়েছে মাত্র ১ দশমিক ৭২ শতাংশ।
রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্যানুযায়ী, ২০১৮ সালে ৩ হাজার ২৯৩ কোটি ডলারের তৈরি পোশাক রপ্তানি হয়েছিল। এরপরের পাঁচ বছরের মধ্যে শুধু ২০২০ সালে পোশাক রপ্তানি কমেছিল। বিদায়ী ২০২৩ সালে রপ্তানি হয়েছে ৪ হাজার ৭৩৮ কোটি ডলারের পোশাক। এই রপ্তানি ২০২২ সালের তুলনায় ৩ দশমিক ৬৫ শতাংশ বেশি।
নতুন কারখানা স্থাপনের বিষয়ে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সিপিডির গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম প্রথম আলোকে বলেন, প্রতিবছর পোশাক রপ্তানি বাড়ছে। এর সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে সক্ষমতাও বাড়ছে। মুনাফা আছে বলেই নতুন বিনিয়োগ হচ্ছে। তাতে কর্মসংস্থান ও রপ্তানি বাড়ছে।
খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম আরও বলেন, ‘আমাদের পোশাক খাতের অধিকাংশ কারখানা কম উৎপাদনশীলতায় কম দামের পোশাক উৎপাদন ও রপ্তানি করে। বড় কারখানাগুলো এখন বেশি দামের পোশাক রপ্তানির পাশাপাশি উৎপাদনশীলতা বাড়াতে বিনিয়োগ করছে। বিনিয়োগে বৈচিত্র্য আনতে দেশের পাশাপাশি বিদেশি বিনিয়োগের সুযোগও দিতে হবে। তবে ইপিজেডের বাইরে বিদেশি বিনিয়োগের সুযোগ কম। চীন, জাপান ও ভারতের জন্য আলাদা অর্থনৈতিক অঞ্চলে এ ধরনের বিনিয়োগের সুযোগ দিলে পোশাক রপ্তানি অন্য ধাপে নেওয়া সম্ভব।