বাংলাদেশে সাম্প্রতিক ভয়াবহ বন্যার প্রেক্ষাপটে দেশের মানুষ যে অসাধারণ সংহতি এবং সহানুভূতি প্রদর্শন করছে, তা নতুন এক অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের প্রতিচ্ছবি। বন্যাকবলিত এলাকাগুলোতে দুর্গতদের সাহায্যে এগিয়ে এসেছে দেশের প্রতিটি ধর্ম-বর্ণের মানুষ। তাদের এই একত্রিত প্রচেষ্টা প্রমাণ করেছে, বাংলাদেশে ধর্মের পার্থক্য মানুষকে আলাদা করে না, বরং সংকটে একত্রিত করে।
গতকাল রাজধানী ঢাকার টিএসসি এলাকা ছিল ব্যস্ত, তবে এই ব্যস্ততা কোনো সাধারণ যানজটের জন্য নয়। রাস্তায় সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে থাকা গাড়িগুলো ভর্তি ছিল ব্যক্তিগত উদ্যোগে সংগ্রহ করা ত্রাণ সামগ্রীতে। দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে নৌকা, ট্রাক, পিক-আপ ভ্যানে করে খাদ্য সামগ্রী, ওষুধ, নিরাপদ পানি এবং অন্যান্য জরুরি সামগ্রী পৌঁছে দেওয়া হচ্ছে বন্যাদুর্গতদের কাছে। অনেক মানুষ তাদের মাসের বেতনের একটি অংশ, দুর্গাপূজা বা হজ্জের জন্য সঞ্চিত অর্থ দান করছেন। এক কথায়, সবাই যেভাবে পারেন সেভাবেই পাশে দাঁড়াচ্ছেন।
এই দৃশ্য শুধু সাধারণ মানুষের নয়। মসজিদ, মন্দিরসহ বিভিন্ন ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানও তাদের তহবিল থেকে সহায়তা প্রদান করছে। বরিশালের বেশ কয়েকটি মন্দির কমিটি তাদের দুর্গাপূজার বাজেটের বড় একটি অংশ বন্যাদুর্গতদের সহায়তায় দান করেছে। এ ছাড়াও ঢাকার মসজিদগুলোতে জুমার নামাজের খুতবায় ইমামরা বন্যাকবলিতদের পাশে দাঁড়ানোর আহ্বান জানিয়েছেন। বিশেষ মোনাজাতের মাধ্যমে বিপদগ্রস্তদের জন্য আল্লাহর কাছে দুআ করা হয়েছে।
স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনগুলোর মধ্যেও সক্রিয়তা লক্ষণীয়। অনেকে বন্যার্তদের জন্য ত্রাণ সামগ্রী বিতরণের উদ্যোগ নিয়েছে। এর মধ্যে চাল, তেল, ডাল, চিড়া, খেজুর, লবণসহ নানাবিধ সামগ্রী রয়েছে, যা ঢাকা থেকে প্যাকেজিং করে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় পাঠানো হচ্ছে। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও সংস্থা একদিনের বেতন দান করছে, এমনকি দেশের মোবাইল অপারেটরগুলোও বন্যাকবলিতদের জন্য ফ্রি টকটাইম ও ইন্টারনেট সুবিধা প্রদান করেছে।
সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোও বন্যাদুর্গতদের সহায়তায় ভূমিকা রাখছে। বাংলাদেশ সেনাবাহিনী, পুলিশ, ফায়ার সার্ভিসসহ বিভিন্ন সরকারি সংস্থা তাদের সর্বোচ্চ সামর্থ্য নিয়ে কাজ করছে। রান্না করা খাবার বিতরণ থেকে শুরু করে উদ্ধার তৎপরতা—সবক্ষেত্রেই তারা সক্রিয়। এসব প্রচেষ্টার মধ্যে একটি বিষয় স্পষ্ট, বাংলাদেশে মানুষের সহানুভূতি এবং সহমর্মিতার যে চেতনা রয়েছে, তা সংকটকালে আরও দৃঢ় হয়েছে। বিভিন্ন ধর্মীয় ও সামাজিক সংগঠনের উদ্যোগ এবং সাধারণ মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ আমাদের দেশকে একটি নতুন উচ্চতায় পৌঁছে দিয়েছে।
বন্যা কবলিত এই সময়টি আমাদের জন্য একটি বড় পরীক্ষা। কিন্তু আমরা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, দেশের প্রতিটি মানুষ একযোগে কাজ করলে এই পরীক্ষায় জয়ী হব। বাংলাদেশ যে অসাম্প্রদায়িক চেতনায় গর্বিত, তা এই সংকটকালে স্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয়েছে। দেশজুড়ে মানুষের এই একতা এবং ভালোবাসা আমাদের স্বপ্নের একটি শান্তিপূর্ণ, সহানুভূতিশীল এবং ঐক্যবদ্ধ বাংলাদেশের প্রতিচ্ছবি।
Author: রাকিব হোসেন, লেখক, গবেষক এবং উন্নয়নকর্মী।
পিএইচডি ফেলো, অর্থনীতি বিভাগ, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়।