৫৩১ কোটি টাকার মধ্যে দুই বছরে ৩৮৭ কোটি টাকা ফেরত দেওয়া হয়েছে। এখনো ১৪৪ কোটি টাকার জন্য ঘুরছেন গ্রাহকেরা।
আলোচিত ইভ্যালিসহ ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছ থেকে গ্রাহকদের টাকা ফেরত এনে দেওয়ার কাজে গতি কমে গেছে। প্রথম এক বছরে টাকা ফেরত দেওয়ার যে গতি ছিল, সেভাবে চললে এত দিনে হয়তো সব গ্রাহকই তাঁদের পাওনা ফেরত পেয়ে যেতেন। দ্বিতীয় বছরে প্রথম বছরের ২৫ শতাংশের মতো টাকা ফেরত দেওয়া হয়েছে।
২০২২ সালের জানুয়ারি মাসে টাকা ফেরত দেওয়ার কার্যক্রম শুরু হয়। তার আগে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের তত্ত্বাবধানে বহুপক্ষীয় বৈঠক হয়। বাংলাদেশ ব্যাংক, ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান এবং গেটওয়ে প্রতিষ্ঠানের যৌথ তালিকা অনুযায়ী টাকা ফেরতের প্রক্রিয়া শুরু করে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। প্রথম বছরে, মানে ২০২২ সালজুড়ে টাকা ফেরত দেওয়ার কার্যক্রম ভালোভাবেই চলে। ৫৩১ কোটি টাকার মধ্যে সেবার গ্রাহকেরা ফেরত পান ৩১০ কোটি টাকা। কিন্তু দ্বিতীয় বছরে, অর্থাৎ ২০২৩ সালে ফেরত দেওয়া হয় ৭৭ কোটি টাকা। এখনো ১৪৪ কোটি টাকা ফেরত পাওয়ার আশায় ঘুরছেন ভুক্তভোগী গ্রাহকেরা। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সূত্রে এসব কথা জানা গেছে।
জানা গেছে, কোনো কোনো ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান আংশিক টাকা ফেরত দিলেও কিছু প্রতিষ্ঠান দেয়নি। কোনো কোনো প্রতিষ্ঠানের কাছে আবার পরিপূর্ণ হিসাব নেই। কোনোটির সব সম্পত্তি জব্দ করা আছে আদালতের নির্দেশে। কোনো কোনো প্রতিষ্ঠানের গ্রাহকদের টাকা আটকে আছে তৃতীয় পক্ষ বা পেমেন্ট গেটওয়ের কাছে।
দুই বছর আগে ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলোতে গ্রাহকদের আটকে থাকা টাকা ফেরত দেওয়ার কার্যক্রমে নেতৃত্ব দিয়ে আসছিলেন বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের তৎকালীন অতিরিক্ত সচিব এ এইচ এম সফিকুজ্জামান। ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলো দেখাশোনা করে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কেন্দ্রীয় ডিজিটাল কমার্স সেল। এ সেল দেখাশোনার দায়িত্ব পালন করে আসছিলেন আবার বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের ডব্লিউটিও অনুবিভাগের মহাপরিচালক (ডিজি)।
এ এইচ এম সফিকুজ্জামান ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের ডিজি হওয়ার পর ই-কমার্স খাত নিয়ে কাজ করেন ডব্লিউটিও সেলের তৎকালীন ডিজি মো. হাফিজুর রহমান। তিনি অবসরে যান ২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে। এরপর ডব্লিউটিও সেলের ডিজি হয়ে আসেন নুসরাত জাবীন বানু। ই-কমার্স খাত নিয়ে তিনি ভালো কিছু করতে না পারায় নতুন করে দায়িত্ব দেওয়া হয় যুগ্ম সচিব আবদুস ছামাদ আল আজাদকে।
বাণিজ্যসচিব তপন কান্তি ঘোষ ও যুগ্ম সচিব আবদুস ছামাদ আল আজাদ বর্তমানে বিদেশে থাকায় তাঁদের সঙ্গে কথা বলা সম্ভব হয়নি। তবে মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা জানান, চলতি সপ্তাহ থেকে এ ব্যাপারে আরও তৎপর হবেন তাঁরা।
বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে তথ্য নিয়ে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় অভিযুক্ত ৩২টি ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের তালিকা তৈরি করেছে। এর মধ্যে ১৮টি প্রতিষ্ঠানই গ্রাহকদের টাকা ফেরত দেয়নি। যদিও তাদের কাছে আটকা টাকার পরিমাণ বেশি নয়। ফেরত না দেওয়া প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে রয়েছে নিডস, টোয়েন্টিফোর টিকেটি, ই-অরেঞ্জ, উইকুম, আকাশনীল, আমার বাজার, আস্থার প্রতীক, বাড়ির দোকান ডটকম, ইনফিনিটি মার্কেটিং, নিডল করপোরেশন, এয়ারমল, বগুড়া ইশপ, ফানাম ডট কম, লাকসুরা এন্টারপ্রাইজ, পল্লী স্টোর ও ই নিডস।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, ৩২টি ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের কাছে গ্রাহকদের মোট পাওনার পরিমাণ ৫৩১ কোটি টাকা। গ্রাহকেরা এখন পর্যন্ত সব মিলিয়ে ফেরত পেয়েছেন ৩৮৭ কোটি টাকা। টাকা ফেরত পেতে তাঁরা বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে আবেদন করছেন। কেউ কেউ ধরনা দিচ্ছেন ই-কমার্স ও গেটওয়ে প্রতিষ্ঠানগুলোতে। বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইনটেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ) এই ৩২টিসহ মোট ৫০টি ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ নিয়ে কাজ করছে।
ফেরত না দেওয়া ১৪৪ কোটি টাকার মধ্যে ৭৭ কোটিই কিউকমের গ্রাহকদের। বাকি টাকা অন্যদের।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কাছে ইভ্যালির গ্রাহকদের সঠিক কোনো তথ্য নেই। তবে ২০২১ সালের ৩০ জুনের পর ইভ্যালিতে আটকে ছিল গ্রাহকদের ২৬ কোটি টাকা। এর মধ্যে মোবাইলে আর্থিক সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান নগদে ১৮ কোটি, বিকাশে প্রায় ৫ কোটি এবং গেটওয়ে প্রতিষ্ঠান এসএসএল কমার্জে ৩ কোটি টাকা ছিল। নগদ, বিকাশ ও এসএসএল কমার্জ ইতিমধ্যে ১০ কোটি ৪৩ লাখ টাকা ফেরত দিয়েছে।
ইভ্যালির সিইও মোহাম্মদ রাসেল প্রথম আলোকে বলেন, ‘ব্যবসা ও পাওনা পরিশোধের কাজ একসঙ্গে চলবে। ২৬ কোটির বাকি টাকা ফেরতের ব্যবস্থা নিতে আরও দুই মাস সময় লাগবে। আর আগের টাকা ফেরত দিতে সময় লাগবে বেশি। আমরা চেষ্টা করছি নতুন বিনিয়োগের। তখন ফেরত দেওয়া সহজ হবে। ভুলভ্রান্তি না করে আমরা নতুন করে আইন মেনে ব্যবসা করতে চাই।’
বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, চলতি সপ্তাহে ইভ্যালির সঙ্গে তাদের বৈঠক রয়েছে। এ বৈঠকে গ্রাহকদের পাওনা পরিশোধ নিয়ে আলোচনা হবে। এদিকে ইভ্যালি আজ শনিবার একটি সংবাদ সম্মেলন ডেকেছে।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে আলেশা মার্টের চেয়ারম্যান মো. মঞ্জুর আলম শিকদার অবশ্য জানিয়েছেন, গেটওয়ে প্রতিষ্ঠান এসএসএল কমার্জের কাছে গ্রাহকদের ৪২ কোটি ৪৩ লাখ টাকা ছিল। এর মধ্যে ৪০ কোটি ৬৭ লাখ টাকা ফেরত পেয়েছেন গ্রাহকেরা। বাকি টাকা ফেরত দিতে একটি তালিকা করা হয়েছে।
ইনভেরিয়েন্ট গ্রুপের প্রতিষ্ঠান ধামাকা শপিংয়ের এমডি জসীম উদ্দিন চিশতী বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে জানান, তাঁর প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ১১৬ কোটি টাকার মানি লন্ডারিংয়ের অভিযোগে মামলা হয়েছে। মামলার অন্য আসামিরা হলেন ইনভেরিয়েন্ট টেলিকমের এমডি জসীম উদ্দিনের স্ত্রী সাইদা রোকসানা খানম, জসীম উদ্দিনের তিন ছেলে তাশফির রেদোয়ান চিশতী, নাজিমউদ্দীন আসিফ, মাশফিক রেদোয়ান চিশতী এবং পরিচালক সাফওয়ান আহমেদ। এর বাইরে গ্রাহক ও মার্চেন্টদের পাওনা রয়েছে আরও ১০০ কোটি টাকা। ২০২১ সালের ৩০ জুনের পর প্রতিষ্ঠানটির কাছে গ্রাহকদের পাওনা ছিল ১ কোটি ২৬ লাখ টাকা। গ্রাহকেরা ফেরত পেয়েছেন ৮৯ লাখ টাকা।
২০২১ সালের ৩০ জুনের পর দালাল প্লাসের কাছে গ্রাহকদের পাওনা ছিল ৩৩ কোটি টাকা। এর মধ্যে পেমেন্ট গেটওয়ে এসএসএলের কাছে ৭ কোটি এবং আরেক পেমেন্ট গেটওয়ে সূর্যমুখীর কাছে ২৬ কোটি টাকা আটকে ছিল। গ্রাহকেরা ফেরত পেয়েছেন ১৮ কোটি ৪৯ লাখ টাকা। এখনো গ্রাহকদের পাওনা ১৫ কোটি টাকার কাছাকাছি।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয় বলছে, পেমেন্ট গেটওয়ে সূর্যমুখীর কাছ থেকে দালাল প্লাসের ৪ হাজার ৩৮০ জন গ্রাহকের তালিকা দেওয়া হয়েছে। প্রতিষ্ঠানটি টাকা ফেরত দিয়েছে ২ হাজার ৪২০ জনের।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের হিসাব অনুযায়ী, কিউকমের কাছে গ্রাহকদের পাওনা ছিল ৩৮৯ কোটি টাকা। এর পেমেন্ট গেটওয়ে প্রতিষ্ঠান ফস্টার করপোরেশন। মোট টাকা থেকে ৪৩ হাজার ৩৬৬ জন গ্রাহককে ৩১২ কোটি টাকা ফেরত দিয়েছে কিউকম। আরও বাকি আছে ৭৭ কোটি টাকা।
কিউকমের সিইও রিপন মিয়া প্রথম আলোকে বলেন, ‘বাকি টাকা ফেরতে আমাদের দিক থেকে প্রস্তুতি নিয়ে রাখা আছে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে একটা বৈঠকের অপেক্ষায় আছি।’
জানা গেছে, কিউকম ও ফস্টারের দ্বন্দ্বের কারণেও গ্রাহকেরা টাকা পাচ্ছেন না। গত বছরের ২৫ মে কিউকমের এমডি রিপন মিয়া ই-মেইলে ফস্টার থেকে টাকা ফেরত আনতে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে অনুরোধ জানান। এর ঠিক এক মাস পর গত ২৫ জুন ফস্টার বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে ৮২ কোটি টাকা ফেরত দিতে ২২ হাজার ৭২৪ জনের একটি তালিকা পাঠায়।
ই-অরেঞ্জের ৬ হাজার ১৭৩ জন গ্রাহকের টাকা ফেরত দিতে একটি তালিকা হয়েছে দেড় বছর আগে। ই-অরেঞ্জের পরিশোধ সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান এসএসএল কমার্জে এ টাকা আটকে ছিল। এসএসএল কমার্জকে নিয়ে ই-অরেঞ্জ একটি হিসাব করেছিল ২০২১ সালের ১৭ আগস্ট। ওই দিনই ই-অরেঞ্জের মূল মালিক সোনিয়া মেহজাবিন ও তাঁর স্বামী মাসুকুর রহমান গ্রেপ্তার হন। পরে গ্রেপ্তার হন প্রতিষ্ঠানটির প্রধান পরিচালন কর্মকর্তা (সিওও) আমান উল্লাহ চৌধুরী।
জানা গেছে, এসএসএল কমার্জে ই-অরেঞ্জের গ্রাহকদের আটকা মোট ৩৪ কোটি ৬৭ লাখ টাকা। তালিকাটি আগে করা ছিল বলে এখন ৪ কোটি ৩০ লাখ টাকা ফেরত দেওয়া সম্ভব।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইন্টারন্যাশনাল বিজনেস বিভাগের অধ্যাপক সুবর্ণ বড়ুয়া প্রথম আলোকে বলেন, ই-কমার্স খাতের ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল। তবে আগের টাকা ফেরত দেওয়াটা জরুরি। কাজটি দ্রুত করতে হবে এবং তা করা সম্ভব। এতে কোম্পানি ব্যবসায়ের ক্ষতি পুষিয়ে নিতে নতুন করে কাজ করার দম পাবে। টাকা ফেরতের ব্যবস্থা করতে না পারলে পুরো দায় বর্তাবে শেষ পর্যন্ত বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের ওপর।