দেশে প্রতিবছর শূন্য দশমিক ৫ শতাংশ হারে কৃষিজমি কমছে। তার বিপরীতে বাড়ছে জনসংখ্যা। এ ছাড়া জলবায়ু পরিবর্তন, ভূরাজনীতি ও প্রযুক্তিগত চ্যালেঞ্জও রয়েছে। তাই স্থানীয়ভাবে কৃষিকাজ ও খাদ্যের উৎপাদন বাড়ানো আবশ্যক। এ জন্য আসছে বাজেটে কৃষি খাতকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে।
বৃহস্পতিবার ‘বাংলাদেশের কৃষির ভবিষ্যৎ ও রাজনৈতিক অর্থনীতি’ শীর্ষক এক সেমিনারে এসব কথা বলেন বক্তারা। রাজধানীর আগারগাঁওয়ে বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) কার্যালয়ে এ সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়। বিআইডিএস মহাপরিচালক বিনায়ক সেনের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন সাবেক কৃষিমন্ত্রী মো. আব্দুর রাজ্জাক।
সেমিনারে বিনায়ক সেন বলেন, দেশের ৪০ শতাংশ মানুষ এখনো সরাসরি কৃষির ওপর নির্ভরশীল। কৃষি ছাড়া বাকি খাতগুলোতে আমদানি স্থিতিস্থাপকতা (ইলাস্টিসিটি) অনেক বেশি। এ ছাড়া আমাদের খাদ্যনিরাপত্তার কথাও বারবার সামনে আসছে। ফলে কৃষি থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নিলে হবে না। আগামী বাজেটে কৃষি খাতকে সবচেয়ে বেশি প্রাধান্য দিতে হবে। কৃষিতে যেসব উন্নত প্রযুক্তি এসেছে, সেগুলো প্রয়োগের ব্যবস্থা করতে হবে।’
বিনায়ক সেন আরও বলেন, কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি বলতে শুধু ধান-চালের কথা বোঝাচ্ছি না। দেশে পোলট্রি ও ফিশারিজ পণ্যের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। এ ক্ষেত্রে ট্যারিফ ও ভর্তুকি নীতি যৌক্তিক করতে হবে। বাজেটে এগুলোকে প্রাধান্য দিতে হবে।
খাদ্যঘাটতি মোকাবিলায় বাণিজ্যিকভাবে বিকল্প ফসল চাষের ভালো সম্ভাবনা রয়েছে বলে অনুষ্ঠানে জানান সাবেক কৃষিমন্ত্রী ও বর্তমানে কৃষি মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি মো. আব্দুর রাজ্জাক। তিনি বলেন, বাংলাদেশ এখনো খাদ্যঘাটতির দেশ। লবণাক্ততা ও সেচ সমস্যার কারণে অনেক জমি বছরের লম্বা সময় ধরে খালি পড়ে থাকে। এ ক্ষেত্রে বাণিজ্যিকভাবে বিকল্প ফসল চাষের ভালো সম্ভাবনা রয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে ধান চাষ বাধাগ্রস্ত না করেই বিকল্প ফসল উৎপাদন করা যায়। এর মাধ্যমে খাদ্যনিরাপত্তা দূর হবে এবং রপ্তানি আয়ও বৃদ্ধি পাবে।
সেমিনারে প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক এম এ সাত্তার মণ্ডল এবং যুক্তরাজ্যের বাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক জিওফ উড। এম এ সাত্তার মণ্ডল জানান, বাংলাদেশের কৃষিতে সাফল্য যেমন আছে, চ্যালেঞ্জও রয়েছে। দেশে প্রতিবছর শূন্য দশমিক ৫ শতাংশ হারে কৃষিজমি কমছে। তার বিপরীতে বাড়ছে মানুষ। ফলে খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিত করা উদ্বেগের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। এর একমাত্র সমাধান হচ্ছে ফসলের উৎপাদন দ্বিগুণ করা।
কৃষিকাজের ধরনেও পরিবর্তন এসেছে বলে জানান এম এ সাত্তার মণ্ডল। তিনি বলেন, আগের ভূমিহীন চাষিরা এখন জমি বর্গা নিয়ে কৃষিকাজ করছেন। এ ছাড়া বাণিজ্যিকভাবে বিকল্প ফসল উৎপাদনও শুরু হয়েছে। তবে জমির মালিকেরা ধান চাষের সঙ্গে আপস করে বাণিজ্যিক উৎপাদনে যেতে রাজি থাকেন না। এটা একটা চ্যালেঞ্জ।
সেমিনারে আলোচক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন গবেষণাপ্রতিষ্ঠান পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টারের (পিপিআরসি) নির্বাহী চেয়ারম্যান অর্থনীতিবিদ হোসেন জিল্লুর রহমান, বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর আতিউর রহমান, বেসরকারি গবেষণা সংস্থা ইকোনমিক রিসার্চ গ্রুপের (ইআরজি) নির্বাহী পরিচালক সাজ্জাদ জহির ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক এম এম আকাশ।
সেমিনারে অর্থনীতিবিদ হোসেন জিল্লুর রহমান বলেন, কৃষি বিষয়ে নীতিনির্ধারণের ক্ষেত্রে সব সময় খাদ্যনিরাপত্তাকে প্রাধান্য দেওয়া হয়। এর থেকে বের হয়ে আসা প্রয়োজন। বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে তৈরি পোশাক ও প্রবাসী আয়ের পরে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ খাত হতে পারে কৃষি। সুতরাং এটিকে প্রাধান্য দিয়ে নীতি গ্রহণ করা প্রয়োজন।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর আতিউর রহমান বলেন, কৃষিজমি ব্যবহার হচ্ছে নগরায়ণের কাজে, যা ফসল উৎপাদনে বড় প্রভাব ফেলছে। অর্থনৈতিক অঞ্চলে শিল্প স্থাপনের জন্য বিনিয়োগ আকর্ষণের চেষ্টা করা হচ্ছে। কৃষিতে বিনিয়োগ আকর্ষণে সে চেষ্টা কম দেখা যায়।
বিভিন্ন বৃহৎ প্রকল্প ও অবকাঠামো উন্নয়নে কৃষিজমি অধিগ্রহণের ফলে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে কৃষকের স্থানচ্যুতি হয়েছে। তাঁদের কৃষিকাজে ধরে রাখার স্থায়ী উদ্যোগের অভাব রয়েছে বলে জানান ইআরজি নির্বাহী পরিচালক সাজ্জাদ জহির। আর এম এম আকাশ বলেন, কৃষি উৎপাদন বাড়াতে ছোট কৃষকদের সহজে ঋণ প্রদান, উন্নত প্রযুক্তির ব্যবস্থা করা ও উপযুক্ত দাম নিশ্চিতের ব্যবস্থা করতে হবে।